ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১

ক্যাম্পাসে প্রাণের উচ্ছ্বাস

জোবাইদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

ক্যাম্পাসে প্রাণের উচ্ছ্বাস

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সূতিকাগার বলা চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সূতিকাগার বলা চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। পুরো আন্দোলনে ঢাবি কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। ঢাবি থেকেই দেশের বিভিন্ন পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে সবশেষে সরকার পতনের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। অভ্যুত্থানপরবর্তী ঢাবির পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, পুরো ঢাবি ক্যাম্পাসেই এক ধরনের স্বস্তি ভাব দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

আগে যেরকম আতংকগ্রস্ত থাকতে হতো শিক্ষার্থীদের সেই পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে। এক কথায় স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করছে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি হলে উদ্যাপিত হয়েছে স্বাধীনতা ২.০ উপলক্ষে হাম্বাভোজসহ সাংস্কৃতিক উৎসব। টিএসসিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সিরাত মাহফিল, বটতলায় হয়েছে কুরআন তেলাওয়াত- এরকম কোনো অনুষ্ঠানের কথা আগে কল্পনাই করা যেত না। দুর্গাপূজার সময় ঢাবি ক্যাম্পাস এরিয়ায় ছিল মানুষ এবং যানবাহনের নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ। পূজার সময় অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটি শেষে গত রবিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আবার পুরোদমে চালু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে ঢাবি ক্যাম্পাস।

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি
এক সময় ঢাবির প্রতিটি হলসহ পুরো ক্যাম্পাসে ছিল ছাত্রলীগের একচ্ছত্র রাজনীতি। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে ঢাবির প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল অনেকে। অনেককে হল থেকে বের করে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিমুক্ত হয়ে শান্তি এবং স্বস্তিতে অবস্থান করছে।

যদিও ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ছাত্রদল কর্মীরা। ছাত্রদলের নতুন সদস্য সংগ্রহের ফরম বিতরণ এবং হলে হলে কমিটি দেওয়ার তোড়জোড়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছুটা। এছাড়া দীর্ঘদিন পর কমিটি প্রকাশ্যে আসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের। এরপরই পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয় ক্যাডারভিত্তিক এই ছাত্রসংগঠনটি নিয়ে।

স্বস্তি ফিরেছে হলগুলোতে
আন্দোলন চলাকালীন সময়েই প্রতিটি হলকে ছাত্রলীগমুক্ত করা হয়েছিল। এরপর সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগ নেতারা এখন পলাতক। অতঃপর প্রতিটি হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে ভেঙে দেওয়া হয় হলের গণরুম-গেস্টরুম কালচার। এখন কোনো হলেই গণরুম নেই। 
প্রতিটি হলেই শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট প্রদান করেছে হল প্রশাসন। যেখানে ফার্স্ট ইয়ারে গণরুমে থাকতে জায়গা পেত না নবীনরা, সেখানে এখন মেধার বৃত্তিতে ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের বৈধ সিট দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন হলে। তবে সিটের ক্ষেত্রে মেয়েদের হলগুলোতে নানা সমস্যা এখনো বিদ্যমান। তাছাড়া মেয়েদের জন্য হল সংকটের সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতাপরবর্তী এই সময়ে। বলা বাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেয়েদের হল সংকট সমাধানে কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে ইতোমধ্যে।
বিভিন্ন হলে নানা ধরনের সংস্কার পরিলক্ষিত হয়েছে। আগে অবাধে যেকোনো হলে প্রবেশ করা গেলেও, বর্তমানে কিছু হলে প্রবেশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে। তাছাড়া হলের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ের সংস্কার করা হয়েছে। গণরুম-গেস্টরুম এবং ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতিমুক্ত প্রতিটি হলে এখন শান্তি এবং স্বস্তির সঙ্গে বসবাস করছে শিক্ষার্থীরা।

ক্লাস পরীক্ষার ব্যস্ততা
অভ্যুত্থানকালীন সময় থেকে দীর্ঘ একটা অচলাবস্থার মধ্যে ছিল ঢাবির ক্লাস পরীক্ষা। ২২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোদমে চালু হয় ঢাবির কার্যক্রম। কিন্তু এরপর পূজা এবং শীতকালীন ছুটিতে আবারও থমকে যায় ক্লাস পরীক্ষা। কয়েকটি বিভাগÑ যেমন আরবি বিভাগে বন্ধের মধ্যেই পরীক্ষা চলেছে। তবে অধিকাংশ বিভাগেরই বন্ধের পর ক্লাস পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ফার্স্ট ইয়ার শিক্ষার্থীদেরও ক্লাস শুরু হয়েছে। নবীনদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে ঢাবি ক্যাম্পাস। কিছু বিভাগের ক্লাস চলছে, আবার কিছু বিভাগের পরীক্ষা চলছে। সব মিলিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত সময় কাটছে ক্লাস এবং পরীক্ষায়।

বিকেলের/সন্ধ্যার টিএসসি
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে টিএসসিতে। চায়ের আড্ডাও জমে ওঠে পুরোদমে। শুধু যে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরাই ভিড় করে এমন নয়, বিভিন্ন প্রান্তের নানা বয়সি মানুষজন আসে টিএসসিতে। টিএসসিতে পাওয়া যায় হরেক রকমের চা। যেমনÑ দুধ চা, গুড় চা, মালটা চা, কাঁচা মরিচের চা, রং চা ইত্যাদি। এছাড়া বেগুনি, চপ, মমো, ঝালমুড়িসহ বিভিন্ন আইটেমের আরও কিছু ভাসমান দোকান দেখতে পাওয়া যায়।

বন্ধুরা মিলে এক জায়গায় বসে চায়ের কাপ হাতে আড্ডায় মেতে যায়, চলে গল্পস্বল্পও। ঢাবির টিএসসির প্রতিদিনের চিত্র এটি। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই বাড়ে লোকসংখ্যা। লোকসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে যানবাহনের সংখ্যাও। বিশেষ করে শুক্রবারসহ প্রায় সব দিনই সন্ধ্যা থেকে তীব্র যানজট শুরু হয় টিএসসি এলাকায়। অবস্থা এমন হয় যে হাঁটাই দায় হয়ে যায়!

মধুর ক্যান্টিন
একসময় মধুর ক্যান্টিন মানেই সবাই বুঝত ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলের আঁতুড়ঘর। স্লোগানে স্লোগানে মুখর থাকত মধুর ক্যান্টিন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ফ্যাসিবাদী ছাত্রসংগঠনটির আর দেখা নেই। ফলে, মধুর ক্যান্টিনেও এখন আর সেরকম স্লোগানের জোয়ার ওঠে না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও আর দেখা যায় না। শিক্ষার্থীরা অবাধে বসে আড্ডা দিতে পারছে মধুর ক্যান্টিনে। 

ঢাবি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি
আগে ভোর রাতে লাইব্রেরির গেট থেকে ব্যাগ দিয়ে সিরিয়াল রাখতে হতো লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এরকম লাইন বা সিরিয়াল দিয়ে রাখতে হচ্ছে না। কারণ, এখন হলগুলোতে বলতে গেলে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থী তেমন নেইÑ যারা বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ভিড় করবে! তবে লাইব্রেরির ই-জোনে কিছু সমস্যা বিদ্যমান। এছাড়া লাইব্রেরির সামনে রাখা সাইকেল এখনও চুরি হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ লাইব্রেরিতে নতুন লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ করা হয়েছে, যাকে শিক্ষার্থীরা আন্তরিক হিসেবে পেয়েছেন।

প্রাণবন্ত সেন্ট্রাল মসজিদ
ঢাবি সেন্ট্রাল মসজিদের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নিতে এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি। টয়লেট, অজুখানার অবস্থা শোচনীয়। মসজিদের ভেতরে নেই কোনো আধুনিকায়ন। মসজিদের সংস্কার এবং আধুনিকায়নের কাজ শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ হাজারো মুসল্লির সমাগম হয় মসজিদে। নামাজের পর মসজিদের সামনে এখানে-ওখানে ছোট ছোট দলে বিভক্ত শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত গল্পের আমেজও চোখে পড়ে। ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের ঘিরে থাকে শিক্ষার্থীরা। এই মসজিদের পাশেই আছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি। তাঁর সমাধিগাত্রে উৎকীর্ণ অমর পঙ্ক্তিÑ ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই...।’

চিরচেনা আড্ডা-গান-কনসার্ট
ঢাবি ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় বসে বন্ধুদের আড্ডা; বটতলা, কলাভবনের সমানে, টিএসসিতে, ডাকসু ক্যান্টিনে, মল চত্বরে। এছাড়া অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে ‘কাসিদা’র কাওয়ালী সন্ধ্যা, ‘কলরব’-এর গজল সন্ধ্যা, টিএসসিতে সিরাত মাহফিল এবং আহত ও বন্যার্তদের জন্য আন্দোলনে ভূমিকা রাখা গানের কনসার্ট হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি হলে হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান-কনসার্টের চিরচেনা রূপে ফিরেছে ঢাবি ক্যাম্পাস।

দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি
ঢাবি ক্যাম্পাসের প্রতিটা দেওয়াল ভরে উঠেছে নানা রকমের গ্রাফিতি দিয়ে। লেখা, আঁকায় অর্থপূর্ণ অনেক বার্তা তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিটা দেয়াল যেন ছবি এবং রঙে সাজের পূর্ণতা পাওয়ার পাশাপাশি অর্থবহ হয়ে উঠেছে। চোখ জুড়ানো এসব গ্রাফিতির ভাষা অন্তরে নাড়া দেয়। সম্প্রতি এসব গ্রাফিতি পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও।

×