ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

শিক্ষার্থী পড়ানোর চাইতে আগ্রহ বেশি উপাচার্য পদে

ভিসি পদে এত মধু !

মোতাহার হোসেন, ঢাবি

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ১২ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ০৯:৩৮, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

ভিসি পদে এত মধু !

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর পাল্টে যায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নানা ফিরিস্তি সামনে আসতে থাকে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে যেমন সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ সরব ছাত্র-জনতা। ইতোমধ্যে ৪২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরও পদ ছাড়তে নারাজ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। পদত্যাগ করা এসব ভিসির মধ্যে অনেকে দায়িত্ব নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে এসব পদে বহুল আগ্রহ নিয়ে আসতে ইচ্ছুক কয়েকশ’ শিক্ষক। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভিসিই নিয়োগ হোক, নিয়োগের পর নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সেই ভিসির পদত্যাগ দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনেক সভা সমাবেশে নগ্ন ভাষায় প্রতিবাদও করেন।

তারপরেও এ পদে টিকে থাকতে চান ভিসিরা। সম্প্রতি ভিসি পদ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ভিসি হতে চান, ক্লাসে পড়াতে চান না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রথম কাজই শিক্ষার্থীদের পড়ানো। উপদেষ্টার এমন মন্তব্যের পর দেশেজুড়ে ভিসি পদ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, এ পদে কি এমন মধু রয়েছে যার কারণে শিক্ষার্থী পড়ানোর চেয়ে ভিসি পদে বেশি আগ্রহ শিক্ষকদের।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের স্বপ্ন ভিসি হওয়া। মূলত দুটি কারণে তারা ভিসি হতে চান। একটি সামাজিক, অন্যটি বাণিজ্যিক। সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। তার মধ্যে ভিসিদের অন্য চোখে দেখা হয়। ভিসি হলে সমাজে পরিচিতি বাড়ে। সরকারসহ দেশী বিদেশী নানা প্রতিষ্ঠানে সম্পর্ক হয়। ভিসির দায়িত্ব শেষ হলে সরকারের বড় পদে দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে, অনেকে ভিসি হতে চান বাণিজ্যিক কারণে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় পদ ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কর্মকাণ্ড তাকে ঘিরে পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ, টেন্ডার সকল কিছুই ভিসির ইচ্ছায় পরিচালিত হয়।

শিক্ষকরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ হয় বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। কোন পদে কত টাকা লাগবে সেটি নির্ভর করে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে সেটির ওপর। তবে, কর্মকর্তা, কর্মচারীর চেয়ে শিক্ষক নিয়োগে তুলনামূলক টাকা কম লাগে। কারণ, অযোগ্যকে যোগ্য বানিয়ে কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু, শিক্ষক হতে হলে টাকা থাকার পাশাপাশি যোগ্যতাও থাকতে হবে। এ সব নিয়োগ সাধারণত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। প্রার্থী খোঁজ, আবেদন করানো, প্রার্থীকে প্রস্তুত করা সবই করে সিন্ডিকেট। শুধু সিন্ডিকেটের পরামর্শে নিয়োগ দেন ভিসি।

তবে, যেসব নিয়োগ বোর্ডে ভিসি থাকতে পারেন না, সেসব বোর্ডে ভিসির নির্দেশে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের নানা কাজে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার হয়। এসব টেন্ডারের টাকার বড় একটি অংশ ভিসি পেয়ে থাকেন। যেহেতু রাজনৈতিকভাবে ভিসি পদ নিয়োগ হয় সেজন্য অনৈতিক কাজ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না সরকার। ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনৈতিক কাজে উৎসাহ দেয় ভিসিদের। তবে, ভিসিদের মধ্যে এমনও শিক্ষক রয়েছেন যারা অনৈতিক লেনদেনের ধারে কাছেও যান না। তবে, সেই সংখ্যা নগণ্য।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ভাতিজা শিক্ষক হওয়ার আবেদন করেন। সে রিটেনেও পাস করেছিল। কিন্তু এ পদের জন্য আমার কাছে টাকা চাওয়া হয় ১৪ লাখ। কিন্তু আমি দিতে রাজি হইনি। পরে অবৈধভাবে আমার ভাতিজাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনিও জানতেন। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  

ঢাবির কলা অনুষদের এক শিক্ষক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ক্ষমতা হলো সৃষ্টিকর্তার পরে। তিনি যেন সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেকে মেয়ে আর মেয়েকে ছেলে বানাতে পারেন না। বাকি সবই সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে চলে। তারপরেও নানা নেতিবাচক খবর হরহামেশায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য মানুষকে মানুষেই মনে করে না।  

ভিসি পদে ইচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, এসব পদে কঠিন প্রতিযোগিতা হয়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে হলে পদ পাওয়ার আগেই লাখ লাখ টাকা নিয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পেছনে ব্যয় করতে হয়। যেসব শিক্ষক আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তারা নিজেরাই টাকা ব্যয় করে এ পদ বাগিয়ে নেন। তবে, যাদের টাকা নাই তারা দ্বারস্থ হন সিন্ডিকেটের কাছে। এ ক্ষেত্রে ভিসি পদে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কোনো টাকা দিতে হয় না। নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সকল কাজই করে সিন্ডিকেট। নিয়োগ থেকে শুরু করে টেন্ডারসহ নানা কাজে হস্তক্ষেপ করে সিন্ডিকেট সেই টাকা তুলে নেয়।

এ সব সিন্ডিকেট সাধারণত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি বানাতে বেশি আগ্রহ দেখায়। কারণ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট বেশি। তা ছাড়া, এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজখবর মানুষ কম রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ছিলেন অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল। তিনি ঢাবির ভিসি হলে এ পদ খালি হয়। শূন্য এ পদ পূরণে আলোচনায় আসেন অন্তত এক ডজন শিক্ষক। তার মধ্যে একজন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান। তিনি প্রশাসনের এ পদে আলোচনায় থাকলেও আর্থিক কারণে পদে আসতে পারেননি। এ পদে আসতে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন অধ্যাপক জিয়ার এক অনুসারী। কিন্তু, ওই ব্যক্তি এ পদের জন্য ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। তবে, টাকা দিয়ে প্রোভিসি হতে রাজি হননি অধ্যাপক জিয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ওই সময়ে আমরা কয়েকজন জিয়া স্যারকে প্রোভিসি বানাতে অনেক চেষ্টা করেছি। আমাদের মধ্যে একজন শেখ পরিবারের এক ব্যক্তির কাছে তদবিরের জন্য যান। পরে তিনি ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। তবে, টাকা ও ওই ব্যক্তির কথা শোনার পর জিয়া স্যার আর আগায়নি।

তবে, ভিন্ন কথা বলছে দায়িত্ব পালন করা ভিসিরা। তাদের মতে, এ পদে আসলে সুযোগ সুবিধা আরও কমে যায়। তবে, তাদের মুখের কথা ও বাস্তবে ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি। তারা সকলেই প্রথমবার ভিসির দায়িত্ব পালনের পর দ্বিতীয়বার এ পদে থাকার চেষ্টা করেছেন। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্ধারণে সবশেষ বিশেষ সিনেট অধিবেশন বসে। ওই সময়ে বিএনপিপন্থি সাদা দল অধিবেশন বর্জন করায় আওয়ামীপন্থি তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে ৩০ জুলাই নীল দলের শিক্ষক প্রতিনিধি ও গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিরা উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নে নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটিতে যান। সেখানে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ঢাবির সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ প্রথম স্থান অধিকার করলেও সিনেট অধিবেশনে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান নিজেকে এক নম্বর ঘোষণা করে প্যানেল দেন। এ নিয়ে অধিবেশনে শিক্ষকরা প্রশ্ন তুললেও উপাচার্য কোনো জবাব না দিয়ে প্যানেল ঘোষণা করেন। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার অভুত্থানের আগে মাকসুদ কামাল উপাচার্য হলেও তৃতীয় মেয়াদে এ পদে থাকতে চেয়েছিলেন অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

ভিসি পদে মানুষের কেন এত আগ্রহ এমন প্রশ্নে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, একজন শিক্ষকই উপাচার্য হন। আমার কাছে এ পদটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। ক্লাসে পড়ানোর মধ্য দিয়ে আনন্দ এবং মর্যাদা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। তবে, উপাচার্য হওয়ার পর শিক্ষার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারলে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, এইটা একটা অসাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশের আপামর সব মানুষ নিজে প্রশাসক হতে চায় বা আপন কেউ প্রশাসক হলে তাকে ব্যবহার করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চান। কেন জানি আমাদের দেশে পিএইচডি একখান করতে পারলে আর একবার অধ্যাপক হয়ে গেলেই মনে করে এইবার শিক্ষকতার ইতি টেনে রাজনীতি ও প্রশাসনে কীভাবে যাওয়া যায় নজর থাকে সেইদিকে। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো পদই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি-ট্রেজারার পদ, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি-প্রোভিসি এবং ট্রেজারার পদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের প্রভোস্ট ও প্রক্টর পদ। বুঝতে পারছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক প্রশাসক পদে নিয়োজিত। এর মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষক পাস গবেষকদের একটা বড় অংশই এখন প্রশাসক। এরা শিক্ষকতা ও গবেষণা থেকে বলা যায় দূরেই থাকবে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার না?

তিনি আরও বলেন, একজন অধ্যাপক কীভাবে প্রভোস্ট কিংবা প্রক্টর হতে চান এইটা আমার মাথাতেই ঢুকে না। প্রভোস্ট হওয়া মানে তো হোটেলের ম্যানেজার। এই কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান শিক্ষককে কেনো দায়িত্ব দিতে হবে? এর মাধ্যমে মেধার কত অপচয় বুঝতে পারছেন? প্রক্টর পদ তো আরও জঘন্য যেখানে একজন শিক্ষককে মারামারি, ঝগড়াঝাটি মেটানোর মতো পুলিশি কাজ করতে হয়। সবাই এইটা হতে চায়, কারণ শুনেছি প্রক্টরদের নাকি অনেক ইনকাম। আর প্রভোস্ট হলে একটা বাংলো পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জরি কমিশনের চেয়ারম্যান (ইউজিসি) ড. এস এম এ ফায়েজ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, পদের প্রতি যার মোহ নাই, কিন্তু সম্মানবোধ আছে তিনিই ভিসি হবেন। একখানে মোহ এবং যোগত্যার চেয়ে সম্মানটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

×