রাজধানীসহ ঢাকা অঞ্চলের শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান নেই
রাজধানীসহ ঢাকা অঞ্চলের শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান নেই। এর মধ্যে কাউকে জোরপূর্বক অবসর দেওয়া হয়েছে। কেউ আবার ছুটিতে। কারও আবার কোনো খবরও নেই। এতে ঢাকার স্কুল কলেজগুলোর কার্যক্রম এক অর্থে ভেঙে পড়েছে। শিক্ষা অফিসগুলো জানায়, প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্দোলন, শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে অস্থিরতা চলছে, যা দ্রুত নিরসন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রার্থনাও করা হয়েছে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ঢাকা অঞ্চলে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নেই তার একটি তালিকা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ৮৮জন প্রতিষ্ঠান প্রধান স্কুল-কলেজে আসছেন না। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দোহার থানার ৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক পদে কেউ নেই।
কেরানীগঞ্জ থানায় এ সংখ্যা ৬। নবাবগঞ্জে ১২, মোহাম্মদপুরে ৭, ধানমন্ডিতে ৪, লালবাগে ৫, শাহআলীতে ৩, মিরপুরে ৫, কাফরুলে ৪, পল্লবীতে ২, কতোয়ালীতে ৯, গুলশানে ৪, ক্যান্টনমেন্টে ৪, রমনায় ৭, বাড্ডায় ৭, উত্তরায় ৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে উপজেলা পর্যায়ে ২১ ও মহানগরীতে ৬৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের এমন অবস্থা রয়েছে।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ জনকণ্ঠকে জানান, ধামরাই, সাভার, ডেমরা ও মতিঝিল থানার পরিসংখ্যান আমাদের হাতে আসেনি। এই চার থানার তথ্য পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানে প্রধানের সংকট শতাধিক হবে।
তবে জনকণ্ঠের হাতে একাধিক প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ পত্র ও তা জোর করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্যামপুর থানার কটন মিল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম পদত্যাগ করেছেন। দোহারের আয়েশা বেগম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুলছুম বেগমের কোনো খোঁজ পায়নি মাউশি। ধামরাইয়ের সূয়াপুর নান্নার স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম তালুকদারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এ ছাড়া কতোয়ালি থানার আনোয়ারা বেগম মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশীদ মোড়ল ও সহকারী প্রধান শিক্ষক কামরুল হাছান মুন্সীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। লালবাগের আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেনকে অপসারণ করা হয়েছে। কেরানীঞ্জের আগানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের তোফাজ্জল হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, বাড্ডা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লা আল মামুন বাসা থেকে পালিয়ে গেছেন। ডেমরার মান্নান হাই স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ৬ মাসের জোরপূর্বক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে জোরপূর্বক অপসারণ ও পদত্যাগের কারণে মামলা ও মন্ত্রণালয়ে এসব শিক্ষকরা আবেদনও করছেন। যার একাধিক চিঠিও জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। গত ১৯ আগস্ট লেখা এক চিঠিতে দেখা যায়, ঢাকার গুলশান মডেল হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুস্তাফা জামান মিয়া শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করেন, চারজন শিক্ষক আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে অধ্যক্ষের পদ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করিয়েছেন। তারা আমাকে কলেজের বাইরে একটি রেস্টুরেন্টে প্রাণ নাশের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
অভিযোগে তিনি আরও লেখেন, ঢাকা মাধমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর একটি পদত্যাগপত্রে জোরপূর্বক আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করে। আমি স্বাক্ষর না দিলে তারা আমাকে নানা রকম হুমকি প্রদর্শন করে। আমি প্রাণ ভয়ে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করি। উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, বোর্ড এখনো প্রতিষ্ঠানের কমিটি ভেঙে দেননি। নিয়মিত কমিটি ও সভাপতি চলমান থাকার পরও তারা সভাপতির অগোচরে বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর পদত্যাগ পত্র তৈরি করে সেই পদত্যাগপত্রে আমার জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়।
জোর জবরদন্তিপূর্বক প্রধান শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্যকরণ সম্পর্কে শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করেছেন নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ স ম ফিরোজ। অভিযোগে তিনি লিখেছেন, দল, শ্রেণী, গোত্র এ সবের উর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করতে আসছি। কখনো কোন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়নি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
এর পর আস্তে আস্তে তা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। গত ১১ আগস্ট একদল তরুণ বিদ্যালয়ে আমার অফিস কক্ষে এসে আমাকে অবরুদ্ধ করে আমার পদত্যাগ পত্রের জন্য হুমকি ধমকি দিতে থাকে। এরই মধ্যে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। তারা কিছু শর্ত দিয়ে আবার ৪ দিন পরে আসবে বলে চলে যায়। কিন্তু তারা অপ্রত্যাশিতভাবে ২ দিনের মধ্যেই আবারও মিছিল সহকারে সশস্ত্র অবস্থায় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে আমাকে খুঁজতে থাকে।
আমি ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়। পরে আমি বিদ্যালয়ে আসলে তারা অনেক বাকবিত-া ও হাঙ্গামা করে সর্বশেষ আমাকে ২৪ ঘণ্টার সময় দিয়ে যায়। বলে এই ২৪ ঘণ্টায় পদত্যাগ না করলে যে কোন উপায়ে তারা পদত্যাগ করাবে। আমি নিজের পরিবার ও সন্তান নিয়ে নিরাপত্তার জন্য এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। পরদিন বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাকে না পেয়ে বিভিন্ন অশ্রাব্য ভাষায় স্লোগান দিতে থাকে ও বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে হুমকি ধমকি দেয় এবং আমার বিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের বাসায় তালা ভেঙে তারা নতুন তালা লাগিয়ে দেয়।
নিজের, স্ত্রী ও সন্তানের বিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমি এক পর্যায় তাদের কম্পোজ করা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হই এবং বাসায় মালামাল নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অরাজকতা বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছে। তাতেও সমাধান না হওয়ায় সর্বশেষ জোরপূর্বক অপসারণ করা যাবে না এমন শর্তে প্রজ্ঞাপনও জারি করে। এদিকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় বেতন বিড়ম্বনাও সৃষ্টি হয়েছে। চলমান সংকট থেকে উত্তরণের বিষয়ে মাউশি মহাপরিচালক রেজাউল ইসলামকে একাধিকবার মোবাইল করা হলেও তিনি ধরেননি।