ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১

নৈপুণ্য অ্যাপ ।। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর নাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য জন্ম নিবন্ধনের নম্বরসহ যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত রয়েছে

কোটি শিক্ষার্থীর তথ্য বেহাত হওয়ার শঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ১ অক্টোবর ২০২৪

কোটি শিক্ষার্থীর তথ্য বেহাত হওয়ার শঙ্কা

নতুন কারিকুলাম বাতিল হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে নৈপুণ্য অ্যাপের ব্যবহার

নতুন কারিকুলাম বাতিল হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে নৈপুণ্য অ্যাপের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হওয়া এই অ্যাপের কার্যকরিতাও শেষ। কিন্তু অ্যাপটিতে এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংবেদনশীল তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে নাম, স্কুল, জন্মনিবন্ধনসহ সবার অভিভাবকের মোবাইল নম্বর আছে। কিন্তু কার্যকারিতা না থাকায় এই অ্যাপের রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না। ফলে কোটি শিক্ষার্থীর তথ্য বেহাত হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিষ্ক্রিয় এই অ্যাপের তথ্যের নিরাপত্তা প্রয়োজন। একইসঙ্গে অর্ধশত কোটির এই অ্যাপের ইতিবাচক কাজে ব্যবহারের তাগিদও দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানায়, অ্যাপটি এসপ্যায়ার টু ইনোভেশন (এটুআই) এটি তৈরি করেছে। এটি এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। অন্যদিকে এটুআই প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, নৈপুণ্য অ্যাপের ভবিষ্যৎ কী, তা তারা জানেন না। এনসিটিবি অ্যাপটি কাজে লাগাতে চাইলে তারা সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন। না হলে হয়তো মুছে ফেলা হবে। নিরপাত্তার বিষয়ে তারা জানান, নৈপুণ্য অ্যাপের কোন ফাংশন নেই। তথ্য-উপাত্ত বেহাত বা চুরি হওয়ার আশঙ্কাও করছেন না তারা। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনেস্কোর আর্থিক সহযোগিতায় ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর অ্যাপটি উন্মুক্ত করা হয়। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অর্ধকোটি টাকা খরচ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মাঝপথে কারিকুলাম পরিবর্তন মূল্যায়নের তথ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত অ্যাপটির কার্যকারিতা বন্ধ করেছে।
শিক্ষকরা জানান, পরীক্ষাহীন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানো হতো। প্রতিদিনের কাজে একজন শিক্ষার্থী কতটা নৈপুণ্য দেখাতে পারছে, তা অ্যাপে থাকা বিভিন্ন নির্দেশকে ক্লিক করে সংরক্ষণ করা যেত। আবার ছয় মাস পর যে ষাণ¥াসিক মূল্যায়ন হতো, সেখানেও শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার সূচকগুলো কিছু অপশনে ক্লিক করে সংরক্ষণ করতে পারতেন শিক্ষকরা।

বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নেও একইভাবে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা সেখানে ইনপুট দিলে সারাবছর একজন শিক্ষার্থীর অ্যাক্টিভিটি অনুযায়ী একটি রিপোর্ট কার্ড দেওয়া হতো। সেটি অনুযায়ী পরবর্তী ক্লাসে উঠত শিক্ষার্থী। ফলে শিক্ষার্থীদের গত এক বছরের অর্জন ও পারদর্শিতাও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির জানান, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর যে রেজিস্ট্রেশন করা হয়, তা অ্যাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। অ্যাপে শিক্ষকদের অংশে সংরক্ষণ করা হতো শিক্ষক নির্দেশিকা। সেখান থেকে শিক্ষকরা সেগুলো দেখে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারতেন। তা ছাড়া পরীক্ষার আগে কেন্দ্রীয়ভাবে এনসিটিবি থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেখানে দেওয়া হতো। ফলে সারাদেশে একই প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছিল।

এনসিটিবির সাবেক সদস্য মশিউজ্জামান মনে করেন, কোচিং বাণিজ্য ও নোটগাইড ব্যবসার যে ধস তৈরি করেছিল প্রথম থেকে তারাই বিরোধিতা করে আসছিল। সবশেষ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, অ্যাপটি নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। তবে প্রথমদিকে ব্যবহার নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলো ধীরে ধীরে সমাধান করা হচ্ছিল।
চলতি বছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। বছরের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন অ্যাপটিতে ইনপুট দেওয়া হয়। ষাণ¥াসিক মূল্যায়নেও ব্যবহার করা হয়। তবে ষাণ¥াসিক মূল্যায়নে চার বিষয়ের মূল্যায়ন নেওয়ার পরই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সেই পরীক্ষাগুলো আর নেওয়া হয়নি। ফলে অ্যাপের ব্যবহারও তখন থেকে স্থগিত।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘অ্যাপটি খারাপ নাকি ভালো সে প্রশ্নে যাব না। কতটুকু ব্যবহার হয়েছে, তাও বিশ্লেষণ করতে যাওয়া বোকামি হবে। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে কাজ হবে কি না, তা সরকার নির্ধারণ করবে। 
অন্যদিকে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, নৈপুণ্য অ্যাপে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। তাদের নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য, জন্ম নিবন্ধনের নম্বর, অভিভাবকের নাম, এনআইডি নম্বর, মোবাইল নম্বর অ্যাপটিতে ইনপুট দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রায় ৫ লাখ শিক্ষকের ব্যক্তিগত তথ্য ও পেশাগত তথ্য রয়েছে। 
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘নৈপুণ্য অ্যাপ এখন স্থগিত। ওটা কোনো কাজে আসছে না। অ্যাপটি যারা তৈরি করেছিলেন, নিয়ন্ত্রণটাও তাদের কাছে। আশা করি, সেখানে থাকা তথ্য-উপাত্ত চুরি বা হ্যাকড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যারা এটি পরিচালনা করছেন, নিশ্চয়ই তারা দায়িত্বশীল।
এ প্রকল্পের এডুকেশন এক্সপার্ট মো. সাজ্জাদ হোসেন খান বলেন, ‘অ্যাপটি এখন বেকার পড়ে আছে এটা ঠিক। তবে এখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বেহাত বা চুরি হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অ্যাপটি সব সময় নার্সিং করছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।

×