ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

ক্যারিয়ার গড়তে ছাত্ররাজনীতি

মুসা বিন মোহাম্মদ

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ক্যারিয়ার গড়তে ছাত্ররাজনীতি

ক্যারিয়ার গড়তে ছাত্ররাজনীতি

নতুন বাংলাদেশে রাজনীতিতে তরুণদের জন্য সোনালি সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচন হচ্ছে। সহ¯্র ছাত্র-জনতার প্রাণোৎসর্গ আর মহান ত্যাগের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন দেশের সামগ্রিক সংস্কারের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়েও নতুনভাবে ভাবছেন তরুণ সমাজ। ছাত্ররাজনীতি কী করে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক হতে পারে এ নিয়ে লিখেছেন মুসা বিন মোহাম্মদ

দেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ এখন তরুণ। ইতোপূর্বে ন্যায্য হিস্যা তো দূরে থাক, রাজনৈতিক দলগুলোয় তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাত্তি জ্বেলেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যে তরুণরা সমাজ পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলেন, তারাই রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার কিংবা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছিলেন। মাঠ দখলের লাঠিয়াল ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তরুণদের আর কোনো মূল্য ছিল না। এখন সেই তরুণরাই এগিয়ে আসছেন স্বপ্নের দেশ বিনির্মাণে, প্রচলিত রাজনীতির অসুস্থ ধারা পাল্টে দিতে। 
গত দুই দশকে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে বিশ্ব এক বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় অংশীজন তরুণরা। ফলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমঅধিকার, লিঙ্গসমতা, পোশাকের স্বাধীনতার মতো বিষয়ে তরুণদের একটা অংশ যে কোনো সময়ের চেয়ে সচেতন। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে তরুণ (১৫ থেকে ২৯ বছর) জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। বিশাল এই তারুণ্য যে কোনো সমাজের জন্যই অমিত এক সম্ভাবনা।

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে তরুণদের জীবনমান পরিবর্তনে নানা অঙ্গীকার করে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করে না। এবার নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের দায়িত্ব কারও হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয় তরুণরা। বরং নতুনভাবে রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। রাজনীতি হবে তরুণদের ক্যারিয়ার গড়ার বড় সহায়ক বা অন্যতম নেয়ামক।
বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের। তাদের ৬৭ শতাংশই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ১২-১৩ শতাংশ তরুণ আনুষ্ঠানিক খাতে বা সম্মানজনক বেতনে চাকরি পাচ্ছেন। দেশের নেতারা তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানেও এমন বিরুদ্ধ পরিবেশ ও অনড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে যে, তরুণরা চাইলেও উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব নয়।  বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবসার সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। এ পরিস্থিতিতে তরুণদের বড় একটা অংশ নিরুপায় হয়ে প্রবাসে সস্তা শ্রমের শ্রমিক হচ্ছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজটাও করা হচ্ছে না। আবার দালালদের খপ্পরে পড়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে, রোদে পুড়ে, শীতে জমে, কারাগারে ধুঁকে অসংখ্য তরুণের প্রাণ যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের পতনে নতুন স্বপ্ন দেখছে তরুণ সমাজ।

সফল ক্যারিয়ার গড়তে
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথে চলেছে, সেখান থেকেও উত্তরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শুধু স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনই ঘটেনি, রাজনীতি সচেতন একটি তরুণ প্রজšে§র উšে§ষ ঘটেছে। যে মূলধারার সম্ভাবনাময় রাজনীতি নিয়ে তারা এতদিন বিমুখ ছিল, সেই রাজনীতিতে এখন তাদের অংশগ্রহণ বা ক্যারিয়ার গঠন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। নয়ত এ রাষ্ট্র আবারও পুরোনো রাজনীতির পথে হাঁটা শুরু করবে। তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিয়ে ইতোমধ্যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়ে গেছে। দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন টগবগে তরুণরা। 
তবে দেশকে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় নিতে ছাত্র-যুবাদের যারা দীর্ঘমেয়াদে সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চান বা জনতার নেতা হতে চান, তারা সর্ব কাজের কাজি হতে হবে। নতুন দেশ গড়তে কোনো কাজে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। কারণ, ভঙ্গুর দেশকে গড়তে হবে শূন্য থেকে শক্ত হাতে। এটা কেবল তরুণ ছাত্ররাই পারবে। এক্ষেত্রে তাদের কৃষিকাজ, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে নিজের বেসিক ‘লাইফ স্কিল’ থাকতে হবে। পরনির্ভরতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তৈরি করে না।
রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে হবে। গ্র্যাজুয়েশন, পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করুন। দিনের একটা ছোট অংশ হলেও পড়ার অভ্যাস করুন। স্টাডি সার্কেল করুন, পেশাগত দক্ষতাহীন লোক ভালো নেতা হতে পারে না, নীতি গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারে না।

প্রায়োগিক জ্ঞান জরুরি
আপনি বিস্তর তত্ত্ব জানতে পারেন, কিন্তু ছাত্রদের দেশের সমস্যার সমাধানে টেকনোক্র্যাটিক সমাধান জানা লাগবে। তত্ত্ব জানাটাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োগও জানতে হবে। প্রতিটি সমস্যার সমাধানসূত্র জানতে হবে, দুটি সমস্যার মধ্যকার সূক্ষ্ম ও স্থূল পার্থক্য জানতে হবে। ছাত্রদের বিশ্লেষণ সক্ষমতা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক নীতি গবেষণা লাগবে। রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান করা লাগবে, দেশের ‘যাবতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে আনপ্লাগ করা লাগবে, বিভিন্ন স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাঝুঁকি সমাধান করা লাগবে। খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা লাগবে। বিদ্যমান সেবাদান পদ্ধতি এবং প্রশাসনের কাজের আধুনিক ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন লাগবে। এর জন্য জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি লাগবে, পলিসি স্টাডি লাগবে। বিভিন্ন ভাষা জানতে হবে।

ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করা
আমলারা তদবির করে, ঠিকাদার সমঝোতা করে যেসব প্রকল্প দাঁড় করায়, সেই প্রকল্পের সমস্যা সমাধান আপনার কাজ নয়। বরং নেতার কাজ সংস্কারকে এগিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা। বিদ্যমান প্রকল্প ও কাজের মূল্যায়ন করে বাজে কাজ, বেদরকারি প্রকল্প থামানো, সরকারের খরচ কমাতে হবে। রাজনৈতিক ইশতেহারে জনতাকে অঙ্গীকার করা মিশন বাস্তবায়নে কৌশলগত মিশন তৈরি করা, দূরদর্শী কৌশল করা, অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য কাজ করা এবং আমলাদের দিয়ে কাজ আদায় করে নেওয়া।

এটা শিক্ষার্থীদের পক্ষে তখনই সম্ভব, যখন তারা নিজে মেরিটোক্রেটিক হবেন, টেকনোক্রেটিক সমাধান জানবেন। অদক্ষ নেতা সরকারের পদ পেলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমলার পাঁকে পড়ে কুপোকাত হওয়া! 
মনে রাখবেন, নেতাকর্মীদের নিয়ে কমিটি করা, ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা, নির্দেশ দেওয়া কিংবা মিছিল মিটিংয়ে হাজির হওয়াÑ এসব দিয়ে নীতিনির্ধারক বা স্টেটসম্যান হওয়া যায় না। শুধু পিপল ম্যানেজমেন্টকে রাজনীতি বলে না। অবশ্যই ছাত্রদের ব্যক্তিগত জীবনেও নীতি ও নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। নিজেদের উৎপাদনশীল রাখতে কাজের সঙ্গে নিজের জীবনের ভারসাম্য রক্ষা বা ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করতে হবে।

ছাত্রদের রাজনীতির ভিত্তি
বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের কাছে ‘নতুন রাজনীতি’র প্রত্যাশা করা যৌক্তিক নয়। কেননা, পুরনো রাজনীতির মধ্যে থেকে পুরনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চর্চা করা হলে দেশের টেকসই উন্নয়নে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। রাজনীতি কঠিন কাজ, ভুলের মাধ্যমে (‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’) রাজনীতিতে শেখা যায়। তবে ১৮ কোটি মানুষের দেশে ভুলের মাশুল কমাতে প্রাক্?-প্রস্তুতি ও ব্যাপক সক্ষমতায় গুরুত্ব দেওয়া চাই। এটাই ‘নতুন রাজনীতি’র ভিত্তি।

ছাত্ররাজনীতির সুযোগ সৃষ্টিতে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ‘নতুন রাজনীতি’ করতে নতুন দলের ইশতেহার, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে নীতি কর্মপরিকল্পনা লাগবে। কর্মসংস্থান কৌশল, আর্থিক ও ব্যাংকিং সংস্কার; নদী রক্ষা, পানি, পরিবেশ, খাদ্য ও কৃষিনিরাপত্তার কৌশলপত্র তৈরি করা লাগবে। ডিজিটাল রূপান্তরের পথনকশা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মাস্টারপ্ল্যান, আইটি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন নীতি কর্মপরিকল্পনা লাগবে। ছাত্ররা এসব বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে মিলে করবে, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মন্ত্রণালয় ও ডোমেইনভিত্তিক রিসোর্স পুল বানাতে হবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কমিশন, রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান গঠন ও সংস্কারের রূপরেখা এবং রোডম্যাপ লাগবে। বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষানীতি তৈরি করতে হবে। স্বৈরাচারের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করেনি- এমন সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ততার রিকল্পনাও লাগবে। ছাত্ররা ‘আইডেনটিটি পলিটিকস’ বা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি করবে।

×