ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১

একই নাম হওয়ায় বিভ্রান্তি বাড়ছে ॥ শেষ ১০ বছরে একই নামে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার হার বেড়ে যায়

২৫ শতাংশ পাবলিক ভার্সিটি শেখ পরিবারের নামে

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২৫ শতাংশ পাবলিক ভার্সিটি শেখ পরিবারের নামে

পাবলিক ভার্সিটি একই নাম হওয়ায় বিভ্রান্তি বাড়ছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একই নামে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। রয়েছে অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি। নামের ভিন্নতা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচিতি নিয়েও বিভ্রাটের অন্ত নেই। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক-চতুর্থাংশ নাম জড়িয়ে আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের নামে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ও স্বয়ং শেখ হাসিনার নামেও দেশের একাধিক জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। 
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাবলিক ৫৫ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ১৩টি শেখ পরিবারের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯টি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। দুইটি বিশ^বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে ফজিলাতুন নেসা মুজিব ও দুইটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে। এর বাইরে মেহেরপুরে আরও একটি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে যা মুজিবনগর বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।

এর আগে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ^বিদ্যালয়গুলোর নাম অনুমোদন দিয়েছে। তবে এখনকার কর্মকর্র্তারা বলছেন একই নাম ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। বরং এই নাম পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফয়েজ জনকণ্ঠকে জানান, এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তা শুনছি। উচ্চপর্যায় থেকে চিন্তা-ভাবনা চলছে। একই নাম কিভাবে এত বিশ^বিদ্যালয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। তবে তখন আমি ছিলাম না, সে কারণে কিভাবে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে সেটি বলতে পারছি না। তবে নাম পরিবর্তনের যদি কোনো বিষয় আসে সেটি অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব।
জানা যায়, এমন অনেক জেলা রয়েছে যেখানে জেলার নামেই বিশ^বিদ্যালয়  স্থাপনের সুযোগ ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই পরিবারের নাম ব্যবহার করে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ নিয়েছিল। কারণ হিসেবে তারা জানান, নাম ব্যবহার করলে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন সহজতর হতো। যে কারণে অনেকেই এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। লালমনিরহাট থেকে জামালপুর এমনকি কিশোরগঞ্জ ও পিরোজপুরেও একই নাম ব্যবহার করে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। তবে গোপালগঞ্জে এই নামে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন সমীচীন বলেও তারা মনে করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে যে ৯টি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে তার নাম হলো- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ^বিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, পিরোজপুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ^বিদ্যালয়, নওগাঁ।

এ ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, সিলেট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয় ও শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, খুলনা। 
বিশ^বিদ্যালয়গুলোর নাম পরিবর্তনে এর আগেও টালবাহানা দেখিয়েছে ইউজিসি। গত বছর ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয় ও রয়েল ইউনিভার্সিটি ‘রয়েল ইউনিভার্সিটি ঢাকা’র পর নাম বদলাতে চেয়ে ইউজিসিতে আবেদন করা হয়। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার নামে করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তাদের প্রস্তাবিত নাম ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি’, যা সংক্ষেপে করা হয়েছে ‘আবেদ ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন নিয়ে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের একটি অংশের উদ্বেগ রয়েছে। তাদের শঙ্কা, নাম পরিবর্তন হলে সনদ নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতার প্রতি সম্মান জানানোর এ উদ্যোগে খুশি ছিল। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি ‘রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা’র নাম পরিবর্তনের আবেদন করে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক এমপি ডা. এইচবিএম ইকবালের প্রয়াত স্ত্রীর নামে ‘ডা. মমতাজ বেগম রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা’ করার জন্য সরকারের অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের অনুমতি পাওয়া যায়নি।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় নাম পরিবর্তনে সরকারের অনুমতি পেয়েছে; সেটি হলো ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে নাম ছিল ‘স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’। তিন মাস আগে তারা নাম পরিবর্তনের অনুমতি পায়।
ইউজিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর, বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নির্মিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিগত সরকারের মন্ত্রিসভা বৈঠকে গত ১২ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর আইন, ২০২০ এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ০২ নং আইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পিরোজপুর শহরে সাময়িকভাবে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে দাপ্তরিক যোগাযোগ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ঢাকায় মিরপুরে একটি লিয়াজোঁ অফিস খোলা হয়েছে। 

সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদের বিশেষ উদ্যোগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কিশোরগঞ্জ জেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ আইন ২০২০ (২০২০ সালের ১৭ নং আইন, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রণীত হয়েছিল।

আইনটি ২০২০ সালে বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক পাস হয়। এই আইনের বিধান অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিশোরগঞ্জ জেলার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই ইউনিয়নের পাটধা ও রঘুনন্দনপুর মৌজায় ১০৩.৮৭ একর জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হবে। এটি কিশোরগঞ্জ শহর থেকে মিঠামইন রোডের দিকে প্রায় ৮.৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। এই বিশ^বিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস লালমনিরহাট যার কার্যক্রম চলমান বলে জানা গেছে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ৪৪তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৭ সালের ২৪ নং আইন অনুযায়ী ২৮ নভেম্বর ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চায় অবস্থিত ৫০০ একর জমি অনুমোদন করেছে।

বিশ^বিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মির্জা আজমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জামালপুর জেলায় একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিশ^বিদ্যালয়গুলো শেখ মুজিবুর রহমানের নামে তৈরি করা হলেও ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট জেলা বা সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যের অবদানকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ, সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বিশেষায়িত ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার কর্তৃক জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলায় বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক সংলগ্ন এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ২০১৯ সালের মার্চ থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটি সরকারি অর্থায়নে ১৩তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি গাজীপুরের সালনায় অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত একটি আইনসহ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (আইপিএসএ) রূপান্তরিত করে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) এর একটি একাডেমিক অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিজ্ঞান কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একাডেমিকভাবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় শাখা জনকণ্ঠকে জানায়, জেলা পর্যায়ের বিশ^বিদ্যালয়গুলো জেলার নামে হওয়াই সমীচীন। যেমন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে। একই নামে ওই জেলায় একাধিক কলেজ আছে। এতে নামের বিভ্রাট তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর নামের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

নামের বিষয়ে এই দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, স্ব-স্ব পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের আইন সংসদে ওঠার পর সেখানে নাম প্রস্তাব করা হয়। সেখান থেকেই আইন ও বিশ^বিদ্যালয়ের নাম প্রস্তাব করা হয়। নাম পরিবর্তনের জন্যও একই পদ্ধতিতে অর্থাৎ সংসদে উত্থাপনের পর পরিবর্তন করতে হবে।

×