ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

ডিসিদের মতো থাকবে ভিসিদের নিয়োগ পুল

উচ্চশিক্ষা সংস্কারে স্বতন্ত্র কমিশনের পরামর্শ

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

উচ্চশিক্ষা সংস্কারে স্বতন্ত্র কমিশনের পরামর্শ

চরম দলীয়করণের প্রভাব পড়েছে উচ্চশিক্ষায়

চরম দলীয়করণের প্রভাব পড়েছে উচ্চশিক্ষায়। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর প্রধানরাও পদত্যাগ করেছেন। কেউবা আবার করতে বাধ্য হয়েছেন। উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষরা পদত্যাগ করায় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন কার্যত অচল। এমন অবস্থায় বিশ^বিদ্যালয়গুলোর শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গ্রেড ১ ও গ্রেড ২ অধ্যাপকদের তালিকাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ^বিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় সব সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ শিক্ষকদের ওপর দায়িত্বভার দেয়। সেক্ষেত্রে যোগ্যদের পাশ কাটিয়ে অযোগ্যরা বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার সুযোগ পান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়েও এই পদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।

তবে ডিসিদের (জেলা প্রশাসক) মতো ভিসিদের (উপাচার্য) ফিট লিস্ট তৈরি করা গেলে অনিয়ম কমিয়ে আনা সম্ভব। ক্রমান্বয়ে পদ ফাঁকা হওয়ার সঙ্গে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগও সেখানে রয়েছে। এক্ষেত্রে আচার্যর দাপ্তরিক আদেশের পরিবর্তে স্বতন্ত্র উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি বলেও মনে করা হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নামে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আচার্য কর্তৃক আদেশ করা হয়। কিন্তু মূল কাজটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রী তাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যক্তিকে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। অথচ দেখা যাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর তদারকি করার জন্য স্বতন্ত্র কমিশন রয়েছে।

যার নাম বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। লোকবলের অভাব, সক্ষমতার ঘাটতির পরও সেখান থেকেই উপাচার্য পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়। এরপর যাচাই-বাছাইয়ের নামে মন্ত্রণালয় পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। যার দ্রুত নিরসন হওয়া প্রয়োজন।
দেশে পাবলিক, প্রাইভেট ও আন্তর্জাতিকসহ তিন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এসব বিশ^বিদ্যালয় চার ধরনের আইনে চলে। যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। এর মধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় চলে একটি আইনে, বাদবাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে আরেকটি আইনে, বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো আলাদা আইনে এবং একাধিক আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় ভিন্ন আইনে পরিচালিত হচ্ছে।
শিক্ষাবিদ ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চশিক্ষায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেই কথা বলছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আলাদা একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনো আগের মতোই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বহির্বিশে^র বিশ^বিদ্যালয়গুলো কিভাবে উপাচার্য নিয়োগ দেয় সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসা উচিত।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে প্রথমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। দেশী ও বিদেশী শিক্ষকরা সেখানে আবেদন করেন। পৃথক একটি সংস্থা এ বিষয়ে স্ক্রিনিং করে। যারা কারিগরি বিষয়টি দেখে শর্ট লিস্ট করে। এরপর স্বাধীন একটি কমিটি উপযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষাতে ডাকবেন। সব বিশ^বিদ্যালয়কে একটি কাঠামোতে আনতে হাবে। যার জন্য স্বতন্ত্র কমিশনের কোনো বিকল্প নেই।

সূত্র জানায়, বিশ^বিদ্যালয়গুলোর অতি রাজনীতিকরণের জন্য মূল দায়ী ছাত্র রাজনীতি নয়। বরং এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী শিক্ষক রাজনীতি। আর এ কারণেই বিশ^বিদ্যালয়গুলো কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। বাড়ছে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। উচ্চশিক্ষা সংস্কারে এ বিষয়েও চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে এখন।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদধারীরা পদত্যাগ শুরু করেন। কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। কেউ পদত্যাগ করেন শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে। ফলে তখন থেকেই শীর্ষ এই পদগুলো শূন্য। তবে শীর্ষ পদ শূন্য থাকায় বেতন-ভাতা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, তা সমাধানে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক কীভাবে নির্ধারণ হবে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক সমস্যায় পড়তে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শুধু শীর্ষ পদ নয়, এই পদের বাইরে প্রক্টর এবং কোথাও কোথাও বিভিন্ন বিভাগের পরিচালকরা পদত্যাগ করেছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবধরনের কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কোথাও কোথাও ঠিকমতো পাঠদানও হচ্ছিল না।  মাস শেষ হলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দায়িত্বশীল কেউ না থাকায় বেতন-ভাতা পাওয়া নিয়েও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
তবে আপৎকালীন সমস্যা সমাধানে উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়, পদত্যাগ ও অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কাউন্সিল, ক্ষেত্রবিশেষে বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করে একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দিয়ে সাময়িকভাবে জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
গত সপ্তাহে দেশের ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপউপাচার্য নিয়োগ করা হয়। একইদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। এর পরেরদিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য  নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ডিনদের থেকে মনোনীত একজনকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ ভুক্ত শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। এ তালিকা ধরেই শীর্ষ পদগুলো পূরণ করা হবে। 
সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘৪০টিরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন আনতে হবে। এটিকে সুযোগও মনে করি। আমরা চাই, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এতদিন এ জায়গায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।’
জানা যায়, উপাচার্য পদ শূন্য থাকায় এরই মধ্যে শিক্ষকরা বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির শুরু করেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে নিজের বায়োডাটা পাঠাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার বুঝেশুনে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করেই শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ দিতে চায়। এ কারণে সময় নিচ্ছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে একজন একজন করে নিয়োগ দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার ক্ষণস্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে পর্যাপ্ত সময়ও নেই। তবে উচ্চশিক্ষার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে এখনই তাদের কাজ শুরু করতে হবে।
বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২৭ জন উপাচার্য, ১২ জন উপউপাচার্য এবং সাতজন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানায়, দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই।

×