ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়েছেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ ত্যাগের পর পাল্টে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চিত্র। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক চেষ্টা তদবিরের পরও স্বপদে টিকে থাকতে পারেনি ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালও। উপাচার্যের পদত্যাগের পর শূন্য হয়ে পড়েছে প্রশাসনের এ শীর্ষ পদ। লোভনীয় এ পদ পেতে ইতোমধ্যে আলোচনায় রয়েছে অর্ধ ডজন শিক্ষকের নাম। আগামী সপ্তাহে আলোচিত এ নামগুলো থেকে একজনকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের কারণে পাল্টে গেছে ঢাবির উপাচার্য নিয়োগের চিত্র। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ১০৫ সদস্যের ভোটে উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত করা হয়। এর আগে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলীয় গ্রুপগুলো নিজেদের মনোনীত প্যানেল প্রস্তাব করেন। পরে সিনেটে ভোটাভুটিতে প্যানেল চূড়ান্ত হওয়ার পর তিন সদস্যের সেই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যায়। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে প্যানেলের বাইরে থেকেও নিয়োগ দিতে পারেন। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন ঢাবির সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। এসব কারণে শেখ হাসিনা পতনের আগেই ঢাবি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি উঠে। তবে, নানা কায়দায় তিনি ঠিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। সর্বশেষ আন্তবর্তীকালীন সরকারের সাথেও যোগযোগ করেছেন। তবে, আশাহত হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপরই নতুন উপাচার্য হিসাবে আলোচনায় আসতে থাকে অর্ধ ডজন শিক্ষকের নাম।
জানা গেছে, সাধারণত উপাচার্য প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচিত হলেও এবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাকে যোগ্য মনে করবেন তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শীর্ষ এসব পদে আসবেন। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুয়ায়ী উপাচার্য নিবাচিত করতে হবে। না হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। আলোচনায় থাকা শিক্ষকরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন।
তবে আলোচিত এসব অধ্যাপকদের মধ্যে উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে শীর্ষে রয়েছেন ড. নিয়াজ আহমেদ খান। ঢাবির এই অধ্যাপক বর্তমানে ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের একাডেমিক অ্যাডভাইজার এবং আরণ্যকের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েলস সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভের দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি কোনো রাজনৈতিক কোন সংগঠনের সাথে জড়িত নয়। যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা অনুয়ায়ী অরাজনৈতিক ও একাডেমিক লোককে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে সেজন্য তিনি উপাচার্য হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি সময়ে ক্যা্ম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে সকল জায়গায় তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ঢাবির উপাচার্য হওয়ার জন্য সাধারনত রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিএনপি-জামাত সমর্থিত সংগঠন শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল থেকে আলোচনায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। তারা হলেন- পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ লুৎফর রহমান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার। অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. ওবায়দুল ইসলাম সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) সভাপতি। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাদা দলের শিক্ষকদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠতা, প্রশাসনিক ও একাডেমিক যোগ্যতা, ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের ওপর ভিত্তি করে তিনি বেশ এগিয়ে রয়েছেন।
ঢাবির পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে দীর্ঘ ৭ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের দুই দুইবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ভদ্র, একাডেমিক লোক হিসাবে তিনি সবার কাছে জনপ্রিয়। অধ্যাপক লুৎফর রহমান বিএনপিপন্থী শিক্ষক নেতা হলেও ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে তিনি জনপ্রিয়। এ কারণে গত কয়েকবছর ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তিনি বড় সাফল্য দেখিয়েছেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি সবসময় পাশে থাকেন। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। তিনি সাদা দলের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ। সৎ ও আর্দশবান, গবেষক হিসাবে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সবসময় জনপ্রিয়। চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনি সাধারন শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। এছাড়া যে কোন যৌক্তিক আন্দোলনে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
বামপন্থি শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে কোন যৌক্তিক আন্দোলনে তাদের সবসময় সরব থাকতে দেখা গেছে। বামপন্থি শিক্ষক হলেও নানা কারণে তারা বিশ্ববিবদ্যঅলয়য়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়।
ঢাবির নতুন উপাচার্য কেমন হলে ভালো এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবি শিক্ষার্থী রিফাত হক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যাকে সবসময় শিক্ষার্থীরা কাছে পাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কাজ করবে উপাচার্য হিসাবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হোক। দায়িত্ব পালনে যিনি দলীয় প্রভাব ব্যবহার করবে না তিনিই যোগ্য লোক। যে কোন বিপদ-আপদে নিজ থেকে এগিয়ে আসবেন এমন উপাচার্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘যাদের নামগুলো আলোচনায় রয়েছে তারা সবাই যোগ্য। স্ব স্ব ক্ষেত্রে তারা সবাই ভালো অবদান রেখেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাকে যোগ্য মনে করবে তাকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিবে।তবে, যোগ্য লোককে মূল্যায়ন করবে আমাদের এমনটি প্রত্যাশা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিয়াজু কমিটির এক সদস্য দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি নাম নিয়ে কাজ করছি। নামগুলো কয়েকদিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রস্তাব করা হবে। আগামী সপ্তাহে আশা করি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
এম হাসান