ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পঞ্চম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে ঢেউয়ের ভাঁজে স্বপ্ন খোঁজে সোনাদিয়ার শিশুরা

মেহেদী হাসান, সোনাদিয়া (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ২৩ মে ২০২৪

পঞ্চম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে ঢেউয়ের ভাঁজে স্বপ্ন খোঁজে সোনাদিয়ার শিশুরা

সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

চারিদিকে সমুদ্রে ঘেরা, মাঝখানে বিচ্ছিন্ন ছোট একটি দ্বীপ কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া। এখানে নোনা জলের গর্জনে ঘুম ভাঙে মানুষের। সমুদ্রের ত্রাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে দ্বীপটির লোকজন। আর সেই স্বপ্ন যেন শুরুতেই থমকে যায়। কারণ, সন্তানদের বেশিদূর পড়ালেখা করাতে পারেন না তারা। সোনাদিয়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছালেও পঞ্চম শ্রেণিতেই পাঠ চুকিয়ে ঢেউয়ের ভাঁজে স্বপ্ন খুঁজতে থাকে সোনাদিয়ার শিশুরা।৯ বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপে মানুষের জীবন-যাপনও খুবই সাধারণ। পলিথিন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি তাদের ঘর। কিন্তু তারপরও শিক্ষা আলো থেকে বঞ্চিত করতে চান না সন্তানদের। দ্বীপের একমাত্র স্কুল সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা চলে এই স্কুলে। কিন্তু দ্বীপটিতে আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা হাই স্কুল না থাকায় পঞ্চম শ্রেণির পরই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি ইচ্ছা থাকা সত্তেও চারিদিকে সমুদ্র থাকায় উপজেলা শহরে গিয়ে শিশুদের পড়াশুনা করা তাদের এবং পরিবারের সম্ভপর নয়। কারণ, যোগাযোগের সহজলভ্য নয়। 

আরও পড়ুন : সুখবর, উপবৃত্তি পাচ্ছেন ৮০ হাজার শিক্ষার্থী

সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজারের নৌঘাট থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে হয় বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। আর যাতায়াতের জন্য নৌযান তেমন একটা নাই এবং ব্যয় সাধ্য। তাই চাইলেই যে কেউ সোনাদিয়া থেকে অন্য কোথাও যেতে পাড়বে না। সোনাদিয়ায় একটি স্কুলই আছে। আর সেটিতে পঞ্চম শেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করানো। হয়। যেসব শিক্ষকরা পাঠদান করান তারাও আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। স্কুলটিতে শিক্ষক আছে মোট ছয় জন। তাই প্রতিদিন ক্লাসও হয়না স্কুলটিতে। স্কুলটি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করা তাকভির জনকণ্ঠকে জানায়, সে এখর আর পড়াশোনা করছে না। কারণ, সোনাদিয়ায় কোনো হাইস্কুল নেই। পঞ্চম শ্রেণির পর এখানে আর কেউ পড়াশোনা করতে পারেনা। তবে স্কুলটির শিক্ষকরা কেমন পড়ায় জানতে চাইলে সে জনায়, শিক্ষকরা খুবই ভালো পড়ায়।

স্কুলটির আরো শিক্ষার্থীরা জনকণ্ঠকে জানায়, তারা তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠদান করে। আবার কেউ কেউ স্কুল পাস করেছে। যারা এখন পড়াশোনা করছে তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করতে পারবে না। কিন্তু তাদের আরও পড়ালেখা করা তীব্র আকাঙ্খা রয়েছে। বর্তমানে স্কুলটিতে ২২০ থেকে ২৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে। এছাড়া প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বের হচ্ছে। আর তার পরই আর পড়ালেখা করার সুযোগ না পেয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করে এসক শিশুরা। আবার অনেকে বাবার সঙ্গে চলে যায় সমুদ্রে মাছ ধরতে। কারণ, এখানে কোনো ফসলের আবাদ না হওয়ায় মাছ ধরা ও লবণ চাষের ওপর নির্ভর করতে হয় সোনাদিয়ার লোকজনকে। 

সোনাদিয়ার বাসিন্দারা জনকণ্ঠকে জানান, ছেলে মেয়েদের আরো পড়াশোনা করানোর ইচ্ছা রয়েছে তাদের। কিন্তু স্কুল না থাকায় পড়াশোনা করাতে পারছেন না। দূরে গিয়ে পড়াশোনা করারও নেই কোনো সহজ মাধ্যম। তাই ইচ্ছা থাকলেও সন্তানদে পড়াশোনা করাতে পারছেন না অবিভাবকরা। এছাড়া, শিক্ষকসংকটের কারণে নিয়মিত সব ক্লাসের পাঠদান হয় না। এমনকি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ নানান কাজেই বাইরে থাকায় প্রতিদিন আসতে পারেন না। সোনাদিয়ায় একটি হাই স্কুলের ব্যবস্থা করা অথবা উপজেলায় গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি সোনাদিয়ার বাসিন্দাদের।  

এ বিষয়ে সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ মোক্তার আহমদ বলেন, কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে বিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কোনো ঘাটতি নেই। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে হাই স্কুল না থাকায় শিক্ষার্থীরা আর বেশিদূর পড়তে পারছে না। যার সাধ্য আছে সে তার সন্তানদের উপজেলায় রেখে পড়ালেখা করায়। মহেশখালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাশ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গুটি ভাঙ্গায় আর একটি স্কুল আছে, সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়। যারা সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চমে শ্রেণি পাস করে তাদের পরামর্শ দেই ওই স্কুলে পড়াশোনা করার। কিন্তু এলাকাটি দুর্গম ও তাদের পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল হওয়ায় দূরে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ কম। আমাদের সাধ্য মতো আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন,‘সেনাদিয়া হলো পিছিয়ে পড়া একটি এলাকা। ওখানকার অধিকাংশ মানুষ জেলে। তাদের শিক্ষার গুরুত্বের বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টাও করে যাচ্ছি। ওই এলাকা থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা যে দূরে গিয়ে পড়বে সেই স্বচ্ছলতা নেই অভিভাবকদের। অনেক শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই পরিবারের ভরণ-পোষণের কাজে লেগে যায়।’এ বিষয়ে উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের বাসিন্দাদের সরকারের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা আছে, আমি এমনটাই জানি।’ 

এম হাসান

সম্পর্কিত বিষয়:

×