বদলির সুযোগ পাচ্ছেন না বেসরকারি পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা
বদলির সুযোগ পাচ্ছেন না বেসরকারি পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। দীর্ঘদিন আলোচনার পর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা বন্ধ হয়ে গেল। যদিও এর আগে তিন কারণে এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে জানিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রণালয়। তবে সর্বশেষ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, লক্ষাধিক শিক্ষক পদ শূন্য থাকা, ভালো স্কুলে যেতে শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা এবং স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ায় এই প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বদলি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশকিছু সমস্যা ধরা পড়েছে। সেকারণে বদলির নীতিমালা সংক্রান্ত সভায় চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সমস্যার বিষয়ে তিনি জানান, সারাদেশে এক লাখের বেশি শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। হঠাৎ বদলির ব্যবস্থা চালু হলে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হবে।
এ ছাড়া যেসব স্কুলের মান খারাপ সেখানে শিক্ষকরা থাকতে চাইবে না। গ্রাম পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট বাড়বে। উপরন্তু শহরের স্কুলে সব শিক্ষক আসতে চাইবেন। এ ছাড়া বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ায় বিধিগত ঝামেলা রয়েছে।
গত ৫ মে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। সভা সূত্রে জানা যায়, শিক্ষামন্ত্রী বদলি নিয়ে সভায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের মতামত জানতে চান।
এ সময় একটি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম চলছে। ৯৬ হাজারের বেশি শূন্যপদ থাকলেও গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্ধেক পদও পূরণ হবে না। এ অবস্থায় বদলি চালু করা হলে গ্রামের সব শিক্ষক শহরে চলে আসবেন। গ্রামের স্কুলগুলোতে খালি হওয়া ওই পদগুলো আর পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য আপাতত বদলি চালু না করতে শিক্ষামন্ত্রীকে মত দেন ওই কর্মকর্তা।
শিক্ষা প্রশাসনের আরেক কর্মকর্তা শিক্ষকদের সরাসরি বদলি চালু করা না গেলে সমপদে এবং সম স্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে এখানে মামলাসহ আরও কিছু জটিলতা দেখা দেওয়ায় এ প্রস্তাব অনুমোদন হয়নি। ফলে আপাতত চালু না করার সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বদলি না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের আচরণ বিধিমালায় পরিবর্তন আসছে বলেও জানানো হয়।
তবে শিক্ষকরা এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং বদলি একটি অধিকার বলে জানিয়েছেন। তারা জানান, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির নীতিমালায় মেধাক্রম অনুযায়ী যে এগিয়ে থাকবে তার বদলির সুযোগই বেশি রাখা হয়েছে। সবাই এক স্কুলে যেতে চাইলেও জনবল কাঠামো অনুসারে সেই সুযোগ নেই। তাদের অভিযোগ, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন, যা খুবই হতাশাজনক।
এনটিআরসিএ শিক্ষক সংগঠনের নেতারা জানান, বাংলাদেশে সব রকম চাকরিতে বদলি থাকলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নয় কেন? এখন যেহেতু সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষক সরকারিভাবেই সুপারিশপ্রাপ্ত হয় সেহেতু বদলিতে আর কোনো বৈষম্য থাকা একেবারেই অযৌক্তিক। বদলির খসড়া অনুসারে এনটিআরসিএ এর মেধা তালিকার ভিত্তিতে যেহেতু শিক্ষকদের বদলি করা হবে, সেক্ষেত্রে ভালো স্কুল, খারাপ স্কুল বা শহরের প্রতিষ্ঠান -গ্রামের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কোনো বিষয় নয়।
বদলিতেও প্রতিযোগিতা তৈরি হবে এবং যে যার মেধাক্রম অনুসারে বদলি হবে। কারও করুণা বা অসদুপায়ের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির আন্তরিকতা ছাড়া বদলিতে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছেন না এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।
এর আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির জন্য ৯০ দিনের মধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শিক্ষা সচিবসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত রিট নিষ্পত্তি করে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
জনবল কাঠামো অনুসারে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির জন্য একটি নীতিমালা বা নির্দেশিকা প্রণয়নে নির্দেশনা চেয়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত ১৩০ জন শিক্ষক ২০২১ সালে রিটটি করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৬ জুন হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বদলির জন্য জনবলকাঠামো অনুযায়ী একটি নীতিমালা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ-সংক্রান্ত রুলের শুনানি শেষে রায় দেওয়া হয়।
সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশ ও কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন। এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করে সেখান থেকেই অবসর নিতে হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের।
এক সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরিভাবে নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিত। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএর অধীন অনুষ্ঠিত পরীক্ষার মাধ্যমে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগে এই পরীক্ষায় পাস করার পর একটি নিবন্ধন সনদ দেওয়া হতো।
এর আগে খসড়া নীতিমালায় বদলির ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতামূলক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, বদলির আবেদন অধিকার বা সুযোগ হিসেবে দাবি করা যাবে না। বদলির জন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠনের সুপারিশ শৃঙ্খলাজনিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বদলির জন্য বদলি হওয়া শিক্ষক কোনো ভাতা পাবেন না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির আবেদন আহ্বান, গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি এই ক্ষমতা অধস্তন দপ্তরে অর্পণ করতে পারবেন। বদলির পুরো প্রক্রিয়াটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। মাউশি বদলির আবেদন ফরম ও সফটওয়্যার তৈরি করবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র এনটিআরসিএর মাধ্যমে যেসব সরকারের ঠিক করে দেওয়া প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরকেই বদলির জন্য বিবেচনায় নিয়েছিল। এমপিওভুক্ত অন্য শিক্ষকরা যেহেতু নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাই তাঁদের আপাতত বদলির বিবেচনায় রাখা হয়নি, যা নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ ও আপত্তি ছিল।
সভাসূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বেশ কিছু ডিজিটাল প্লাটফর্মে শিক্ষকদের সক্রিয়তা রয়েছে। মাঝে মাঝে তারা আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার জন্য নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছেন। যে কারণে বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হবে, যা ভঙ্গ করলে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে শিক্ষকদের।