এইচএসসি পরীক্ষার্থী
চলমান এইচএসসির বাংলা প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো শিক্ষককে শনাক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তিনি ঝিনাইদহের মহেশপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। অবাক করা তথ্য হলো এই শিক্ষক দীর্ঘ ২২ বছর ধরে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত। প্রশ্ন প্রণয়নের বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমনকি বাংলা বিষয়ে বাজারে দুটি বইও আছে তার। তবে এই ঘটনার পর থেকেই তিনি মুঠোফোন বন্ধ রেখেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত ৪ প্রশ্ন মডারেটরকেও খুঁজে পাওয়া গেছে। মূলত যশোর শিক্ষাবোর্ড থেকেই এই প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়।
নজিরবিহীন এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে যশোর শিক্ষাবোর্ড। তদন্ত শেষেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্নপত্র মডারেটর (পরিশোধনকারী) হলেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দিন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইল মির্জাপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ ও কুষ্টিয়া ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
এ বিষয়ে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আহসান হাবীব জনকণ্ঠকে বলেন, এই জাতীয় বক্তব্য একজন শিক্ষিত মানুষ করতে পারে, বলতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে এটা ভাবতেও গাটা ঘিন ঘিন করছে। এই ঘটনার পরই আমরা ঢাকা বোর্ড থেকে চিঠি পেয়েছি। চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটি ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে আমাদের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এখান থেকে বিধি-মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হবে।
যশোর শিক্ষাবোর্ড সূত্র জানায়, যিনি প্রশ্ন করেছেন তিনি তার ফোন বন্ধ রেখেছেন। যশোর বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমি মীরজাফরকে বোঝানোর জন্যই এমনটি করেছি। কিন্তু যা বোর্ডের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দীপক ব্যবহার করবেন একজন শিক্ষক তা হতে পারে না। তদন্ত শেষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা অনুরোধ জানাব। তবে শিক্ষাবোর্ডের ক্ষমতা হলো এমন অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে প্রশ্ন প্রণয়ন বা পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে সম্পৃক্ত না রাখা। বোর্ড থেকে অভিযোগ প্রমাণিত হলে এমন ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার বিধি অনুযায়ী অভিযুক্ত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। আগেও প্রশ্ন প্রণয়নে সংবেদনশীলতার কারণে একাধিক শিক্ষক অভিযুক্ত হয়েছেন। অনেকে জেলও খেটেছেন। এ বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কোনো কারণ নেই। অনেক শিক্ষক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, সামনের বছর নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। এ বিষয়গুলো এখন বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। না হলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। কাজেই স্বাধীনতা ভোগ করতে শিক্ষকদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পালন করতে পারলে তাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া পাওয়া, দাবি, মানমর্যাদা পূরণ হবে।
যে পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন
প্রতিটি শিক্ষাবোর্ড থেকে চারজন সেটার নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট অর্থাৎ বোর্ড থেকে প্রদত্ত তালিকা আছে। তারা বোর্ডকে পরীক্ষক তালিকা সরবরাহ করে। সেখান থেকে সর্বোচ্চ অভিজ্ঞদের প্রশ্নপত্র সেটার (প্রণয়নকারী) হিসেবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে। সূত্র জানায়, যিনি প্রশ্ন করেছেন অর্থাৎ প্রশান্ত কুমার তার এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা ২২ বছর। তিনি পিকিউআই এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এবং বাংলা বিষয়ের ওপর লেখা তার দুটি বই বাজারে পাওয়া যায়। তিনি প্রশ্নপত্রটি সেট করেন। এরপর বোর্ডে সিলগালা করে পাঠিয়ে দেন। ওই সিলগালা করা প্রশ্ন চারজন মডারেটরকে হাতে তুলে দেওয়া হয়। এটা বোর্ড চেয়ারম্যান, কন্ট্রোলার কারও দেখার অধিকার নেই। চারজন মডারেটর ওই প্রশ্নগুলো খুলেন। খুলে মডারেশন করেন। সেখানে ত্রæটি-বিচ্যুতি, রাষ্ট্রবিরোধী কিছু আছে কী না, ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত লাগে বা সাম্প্রদায়িক এমন কিছু আছে কী না সে বিষয়টি দেখা হয়। এ বিষয়ে শিক্ষাবোর্ড থেকে মৌখিক নির্দেশের সঙ্গে লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়। ৪ জন মডারেটর প্রশ্নগুলো মডারেশন (সংশোধন) করেন। এরপর আবার তা সিলগালা করা হয়। প্রশ্ন নিয়ন্ত্রকসহ কারও এই প্রশ্ন দেখার এখতিয়ার নেই। এবার ওই সিলগালা প্রশ্ন ঢাকায় পাঠানো হয়। লটারির মাধ্যমে যে বোর্ড পায়, তা বিজি প্রেসে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেই বোর্ডেরও দেখার সুযোগ থাকে না সেখানে কি আছে। যিনি প্রশ্নটা টাইপ করেন বা প্রিন্ট করেন তিনি প্রশ্নটা খুলে বের করেন। এ বিষয়ে যশোর শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান আহসান হাবীব বলেন, চার সেট প্রশ্ন প্রণয়ন হয়। এরমধ্যে এই যে প্রশ্ন নিয়ে এত আলোচনা সেটি তৈরি করেছেন ঝিনাইদহের মহেশপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। এই ঘটনার পর থেকে তিনি একবারমাত্র যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিষয়টি যে এমন হবে তা বুঝতে পারেননি বলে দাবি করেন। কিন্তু এরপর থেকেই নিজের মুঠোফোনটি বন্ধ রেখেছেন এই শিক্ষক।
অভিযুক্তরা যা বলছেন
যশোরের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পালের ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বলাই চন্দ্র পাল জানিয়েছেন, প্রশান্ত কুমার পালের হাত দিয়ে এমন প্রশ্ন কীভাবে হলো বুঝতে পারছেন না। কিন্তু যেটি হয়ে গেছে সেটি তো সত্য। এখন বোর্ড যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী তিনি পদক্ষেপ নেবেন। প্রশ্নপত্রের মডারেটর নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দিন শাওন বলেন, তিনি ওই প্রশ্নের মডারেশনে ছিলেন। এ ধরনের প্রশ্ন থাকলে তা সংশোধন করে দেওয়া হয়; অথবা কেটে নতুন প্রশ্ন সংযোজন করা হয়। কিন্তু কীভাবে এই প্রশ্নটি রয়ে গেল তা বুঝতে পারছেন না।
যা ছিল প্রশ্নপত্রে
এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উস্কানি নিয়ে সারাদেশে তৈরি হয়েছে হৈচৈ। গত রবিবার সারা দেশে এইচএসসি বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই ৫ শিক্ষক যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তারা ফৌজদারী অপরাধ করেছেন। এমন একটি স্ট্যাটাসও কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতো। আর পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এমন শব্দ ব্যবহার, ধর্মীয় উস্কানির জন্য অবশ্যই এসব শিক্ষককে আইনের আওতায় আনা উচিত। এক্ষেত্রে যদি শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা হবে এক প্রকার লঘুদণ্ড। এই ৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ডকে আহ্বান জানান তারা।
চলতি বছর এসএসসির পর এইচএসসি পরীক্ষায় যা ঘটছে তা নিয়ে বিব্রত শিক্ষাবোর্ডগুলোও। এসএসসিতে কেন্দ্রসচিবের প্রশ্নফাঁস এরপর এইচএসসিতে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও কারিগরির প্রথম পরীক্ষা বাতিল বড় উদাহরণ হয়ে থাকল। এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, দৃষ্টান্তমূলক বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীও জিরো টলারেন্সে আছেন। বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ যা যা নেওয়া প্রয়োজন সব নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করা হবে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের দেশ। এ দেশে কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উস্কানির মতো কিছু থাকবে তা খুবই দুঃখজনক ও একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে যারা সাম্প্রদায়িক উস্কানির বীজ বপন করতে চায় তাদের ভবিষ্যতে এসব কাজের সঙ্গে (প্রশ্নপত্র সেটিং-মডারেটিং) আর সম্পৃক্ত করা হবে না। একই সঙ্গে যারা প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভুল প্রশ্ন বিতরণে বন্ধ হয় কারিগরির পরীক্ষা
এ ছাড়াও এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন পরিচালিত এইচএসসির (বিএমটি) বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষাবোর্ড সূত্র জানায়, ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণে পরীক্ষা চলার এক ঘণ্টা পর পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। এরপর কারিগরি শিক্ষাবোর্ড বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা স্থগিত করে। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন আলী জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার আগে যে সিলেবাস দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের মিল ছিল না। পরীক্ষা শুরু হতেই এ খবর আমরা পাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে সময় চলে গেছে। ফলে এক ঘণ্টা পরীক্ষা আয়োজনের পর স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এবং তদন্তে কারণ খুঁজে বের করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে নতুন ও পুরনো প্রশ্ন গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সেটা শিক্ষা বোর্ড করেছে বলে আমাদের এখনো মনে হচ্ছে না। আমাদের মনে হচ্ছে যে প্রশ্ন যখন ছাপা হয়েছে, ছাপা হওয়ার ক্ষেত্রে একটা ত্রুটি থেকে যেতে পারে। আরেকটা হচ্ছে, ছাপা হওয়ার পরে যে প্যাকিং। কোনো একটা পর্যায়ে ত্রুটি ঘটেছে। যে কারণে এটা স্থগিত করা হয়েছে।