ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খুঁড়িয়ে চলছে কর্মজীবি শিশুদের স্কুল

প্রকাশিত: ১৪:১৯, ১৫ অক্টোবর ২০২২; আপডেট: ১৪:২৪, ১৫ অক্টোবর ২০২২

খুঁড়িয়ে চলছে কর্মজীবি শিশুদের স্কুল

শিশু শিক্ষার্থী

মাথার উপর টিনের চালা। তার কিছু অংশ ফুটো। সেখান দিয়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ে। ক্লাসের দেয়াল জুড়ে রংহীন ময়লা দাগ। ক্লাসে নেই ডিজিটাল ডিভাইসের কোন ছোয়া। এভাবেই খুড়িয়ে চলছে কর্মজীবি শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম। 

পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, ভাল ক্লাস রুম সংকট ও ডিজিটাল ডিভাইস না থাকায় সরকারের এ মহতী উদ্যোগ কাজে আসছে না। ফলে কাগজে কলমে ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর জীবনে লেখাপড়ার ছাপ পড়ছে কম। সর্বশেষ এসব শিক্ষার্থীদের ট্রেন্ড করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমূখী শিক্ষা দেওয়া গেলে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হত।

সুবিধাবঞ্চিত, হতদরিদ্র ও শ্রমজীবি শিশু কিশোরদের মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ১৯৮৯ সালে পথকলি ট্রাস্ট নামে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে এর নামকরণ করা হয় শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০৪টি স্কুলে এসব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। ২০৪টি স্কুলের মধ্যে ৮৭টির বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন আছে। এর বাইরে ৬৯টি চলছে সরকারি প্রাথমিকের ভবনে, ৩৩টি ভাড়া ভবনে ও ১৫টি অন্যান্য স্থাপনায় চলছে।

সুযোগ ও সুবিধার অভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী
দেশের অন্যান্য সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের পেনশন সুবিধা দেওয়া হলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট। এসব স্কুলের ৯৫০ জন শিক্ষক ও ২১৮ জন কর্মচারীকে কোন ধরনের পেনশন ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয় না। চাকরি জীবন শেষে তাদের কোন আর্থিক নিরাপত্তা থাকে না। সরকারি পর্যায়ের স্কুলগুলোতে প্রতিবছর ১ লাখ টাকা পর্যন্ত উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হলেও এসব স্কুলে দেওয়া হয় মাত্র ৬ হাজার টাকা। শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মজীবি ও সুবিধা বঞ্চিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা ও আর্থিক বৃত্তি দেওয়া হলে শিশু শিক্ষায় আকৃষ্ট করা যেত। কারণ অধিকাংশ শিশু রাজধানীর মোটর সাইকেল গ্যারেজ, ওয়ার্কশপের কর্মজীবি। তাদের একদিনে কাজ করলে হয়তো দুশো-তিনশো টাকা মজুরী পায়। কাজ বাদ দিয়ে কেন তারা পড়াশুনো করবে? এছাড়াও ক্লাসরুমে প্রয়োজন ভাল পরিবেশ। কারণ তাদের কর্মপরিবেশ ভাল নয়। এখানে যদি তাদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেওয়া যেত তবে তারা স্কুলমুখী হতো। যেকারণে এসব স্কুলের শিক্ষার্থী কমছে। পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।

তবে স্বল্প সুযোগের পরও এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজ করছে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের নানা শাখায়। এদেরই একজন যশোরের মোঃ আবদুল হামিদ। কেশবপুরের শিশু কল্যাণ থেকে প্রাথমিক শেষ করে পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। শিশু কল্যান ট্রাস্ট্রের জয়পুরহাট স্কুল থেকে ২০০৪ সালে পাস করেন উনজিলা আক্তার। বর্তমানে তিনি ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত। শুধু হামিদ বা উনজিলা নয়। শিশু কল্যান থেকে পাস করে সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বক্সার হয়েছেন এমন ঘটনাও আছে।

বরাদ্দ যেভাবে আসছে
প্রধানত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের উপর নির্ভর করে চলছে কর্মজীবি শিশুদের এ শিক্ষাকার্যক্রম। সর্বশেষ অর্থবছরে শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রকে ৪৩ কোটি ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা। তবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ এই অর্থ ব্যয় করা হয়। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া ১০ কোটি টাকা যা বর্তমান ১৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার এন্ডাউমেন্ট ফান্ডে আছে। এর থেকে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৪০ শিক্ষার্থীকে প্রায় ১০ কোটি টাকা বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। 

দেশের ৬৪ জেলায় ১০০টি উপজেলা মিলিয়ে ২০৪টি স্কুল রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে স্কুল সংখ্যা ৬৫, ময়মনসিংহে ১৪, বরিশালে ২৫, চট্টগ্রামে ১১, সিলেটে, ৫টি, রাজশাহীতে ২২টি, রংপুরে ৪৬টি ও খুলনা বিভাগে ১৬টি স্কুল রয়েছে। এছাড়াও ৬টি শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রের স্কুলে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। সেখানে এসব শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষাদানও করা হয়। এসব স্কুলে শিক্ষার্থীরা সংখ্যা ৩০ হাজার ৮৬০ জন। এরমধ্যে ঢাকার স্কুলে শিক্ষার্থী আছে ৪ হাজার ৮৭৫ জন।

ঢাকায় ২৫ স্কুল
ঢাকায় পথ ও শ্রমজীবি শিশু সংখ্যার নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে ধারণা করা হয় ঢাকা ও এর আশেপাশে পথশিশু ও দরিদ্র শিশুর আধিক্য আছে। যেকারণে রাজধানীতে প্রয়োজন এমন কয়েকশ স্কুল। কিন্তু বাস্তবে ঢাকায় রয়েছে শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রের অধীনে মাত্র ২৫টি স্কুল। এরমধ্যে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব জায়গায়। 

একটি ধোলাইখালের পরিত্যাক্ত ভবনে ও যাত্রাবাড়ির দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জায়গায়। বাকী ২২টি চলছে সরকারি বিদ্যালয়ে। ঢাকার যে ২৫ স্কুল আছে সেখানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। তবে প্রাথ-প্রাথমিক পর্যায়ে ৯টি স্কুলে একজন শিক্ষার্থীও ভর্তি নেই। অন্যদিকে ঢাকার ধলপূরে ৭ জন, তুরাগে ৯, আগারগাঁওতে ১৫, উত্তর বাড্ডায় ১২, খিলগাঁওতে ৭ শিক্ষার্থী। সবমিলিয়ে ২৫ বিদ্যালয়ে প্রাক্-প্রাথমিকে ২২৮ বালক ও ২৫২ মেয়ে পড়াশুনো করে। সাধারণক বিকেল থেকে এসব স্কুলে পাঠদান করানো হয়।

ট্রাস্ট্রি বোর্ড
শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ট্রাস্ট্রিবোর্ডে ৮ জন সদস্য থাকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এই ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান। মন্ত্রী না থাকলে প্রতিমন্ত্রী চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন ও সচিব সদস্য থাকেন পদাধিকার বলে। এর বাইরেও সরকার কর্তৃক মনোনীত চারজন সদস্য থাকেন। ট্রাস্ট্রের কাজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও  তদারকি। শিশু কল্যাণ বিদ্যালয়গুলোতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা গ্রহণ। নিয়মিত এসব স্কুল পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান। তবে করোনায় ট্রাস্ট্রিবোর্ডের বৈঠকও হয়েছে হাতে গোনা। 

যা বলছে কর্তৃপক্ষ
শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক (উপসচিব) মো. আবুল বাশার সার্বিক বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা না দিতে পারা সত্যিই কষ্টের। এখন পর্যন্ত ৪৮ শিক্ষক কোন পেনশন না পেয়ে অবসরে গেছেন। স্থায়ী ভবন না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাও বেশ দুরুহ। তবে  শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট নামে একটি আইনের খসড়া হয়েছে ২০২০ সালে। আইনটি প্রণয়ন হলে প্রায় সব সংকট কেটে যাবে।চলতি মাসে এই আইনের খসড়া ট্রাস্ট্রিবোর্ড গ্রহণ করেছে। এরপর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে ক্যাবিনেটে পাঠানো হবে।

এসআর

×