ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ মার্চ ২০২৫, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১

সবুজ বিপ্লবে সাহসী উদ্যোক্তা

আবুল বাশার মিরাজ

প্রকাশিত: ১৯:০২, ১ মার্চ ২০২৫

সবুজ বিপ্লবে সাহসী উদ্যোক্তা

রাজধানীর ব্যস্ত নগরজীবনে প্রকৃতির ছোঁয়া নিয়ে এসেছে ‘ওরেন্ডা অ্যান্ড বিন্স’। রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় অবস্থিত প্রধান সড়কের পাশে দ্বিতীয় তলার ছাদে গাছপালায় ঘেরা, সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল এই ক্যাফে শুধু একটি খাবারের জায়গা নয়, বরং এটি এক নতুন ধারার প্রতিচিত্র। রেস্টুরেন্টটির ছাদে অত্যাধুনিক ছোলার সিস্টেম বসিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়িক মডেলের এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নারী উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস।
বাংলাদেশে যেখানে অধিকাংশ রেস্তোরাঁ গ্যাস ও বিদ্যুৎনির্ভর, সেখানে তিনি বেছে নিয়েছেন সৌরশক্তিকে। তার ক্যাফের রান্নাঘর, আলোকসজ্জা, এমনকি কফি মেশিন পর্যন্ত চলে পুরোপুরি সৌরবিদ্যুতের ওপর। এতে যেমন বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের নজির গড়া সম্ভব হচ্ছে। শুধু শক্তি ব্যবহারে নয়, ক্যাফের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাতেও রাখা হয়েছে প্রাকৃতিক উপকরণের ছোঁয়া। প্লাস্টিকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাগজের সামগ্রী, খাবার পরিবেশনের জন্য নেওয়া হয়েছে পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং উপকরণ। এসব উদ্যোগ ক্যাফেটিকে শুধু পরিবেশবান্ধব নয় বরং সচেতন নাগরিকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার জায়গায় পরিণত করেছে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, ‘ওরেন্ডা অ্যান্ড বিন্স’Ñএর লভ্যাংশের একটি অংশ তারা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করে থাকেন। তিনি আরও বলেন, এই উদ্যোগের পেছনে তার বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তার বড় ভাই, লন্ডন প্রবাসী মঞ্জুর মিয়া। বিদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার দেখে তিনিই তাকে এ বিষয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর নানা পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেয় ‘ওরেন্ডা অ্যান্ড বিন্স’। কিন্তু তার লক্ষ্য শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি চান, নারীরা আরও বেশি উদ্যোক্তা হয়ে উঠুক, নিজেদের পায়ে দাঁড়াক। ভবিষ্যতে তিনি একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে নারীরা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্পর্কে শিখতে পারবেন।
ভবিষ্যতে জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে চান। তিনি চান, তার মতো আরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুক, পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ উদ্যোগ গড়ে তুলুক। তার স্বপ্ন, একদিন বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে একটি রোল মডেল হয়ে উঠবে এবং ‘ওরেন্ডা অ্যান্ড বিন্স’-এর মতো উদ্যোগগুলো দেশের সবখানে বিস্তৃত হবে। তিনি বিশ্বাস করেন, সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। তার মতে, পরিবেশ রক্ষার জন্য শুধু বৃক্ষরোপণ নয়, বরং টেকসই ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, প্লাস্টিক বর্জন এবং সচেতন জীবনধারার চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশকেন্দ্রিক বিষয়গুলো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সংকটময় সময়ে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনা মহামারির সময় ফ্রন্টলাইনে কাজ করেছেন, অসহায় মানুষদের সহায়তা দিয়েছেন। সাম্প্রতিক বন্যার সময়ও দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। শুধু দুর্যোগকালেই নয়, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায় মানুষদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা নিশ্চিত করতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও তিনি শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা, অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করছেন।
তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-তে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে দ্বিতীয় মাস্টার্স করছেন। তার লক্ষ্য, কিভাবে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো টেকসইভাবে পরিচালনা করা যায় এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব। তবে জান্নাতুল ফেরদৌস শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি একজন সমাজকর্মীও। গত ৯ বছর ধরে তিনি দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং বর্তমানে ব্যবসায়ের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন। বিশেষ করে অনাথ শিশু ও শেল্টার হোমগুলোর কল্যাণে কাজ করা তার অন্যতম প্রধান উদ্যোগ।

×