ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

গণরুম মুক্ত হলো জাবি, র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার প্রত্যয়

জাবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ২২:০১, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

গণরুম মুক্ত হলো জাবি, র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার প্রত্যয়

গণরুম এবং হল

দেশের একমাত্র ‘পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়’ খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হলে নির্দিষ্ট আসন বরাদ্দের কথা থাকলেও, বিগত দেড় যুগেরও বেশী সময় ধরে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন। ফলসরূপ নবীন শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে ‘গণরুম’ নামক এক কক্ষে গাদাগাদি করে অবস্থান করতে হতো।

এসব সংকট নিরসনে নতুন কয়েকটি হলও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তাতেও কাটেনি সংকট। মূলত রাজনৈতিক ব্লকের নামে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের জোরপূর্বক রুম দখল, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চারজনের কক্ষ এক বা দুজনে দখল করে রাখা, ছাত্রত্ব শেষ হলেও বছরের পর বছর হলে অবস্থান করা এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় আসন বন্টণ ও নিশ্চিতকরণে হল প্রশাসন ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে বছরের পর বছর ধরে এই কৃত্রিম সংকট বিরাজ করে আসছিলো।

তবে গণঅভ্যুত্থানের পর পাল্টে গেছে এই চিত্র। একদিকে হল থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে গণরুম। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ ও নিশ্চিত করা হয়েছে নির্দিষ্ট আসন। অপরদিকে র‍্যাগিং ও গেস্টরুম কালচার বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, রবিবার (২০ অক্টোবর) থেকে শুরু হচ্ছে প্রথম বর্ষের শ্রেণি কার্যক্রম। ক্লাস শুরুকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাত থেকেই নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের আনাচে—কানাচে তাদের পদচারণা যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। বিশ^বিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনেই আবাসিক হলে আবাসন নিশ্চিত হওয়ায় এই উৎসবে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

এর আগে, গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ও পোষ্যদের আবাসিক হল ছাড়তে পাঁচ কর্মদিবস সময় বেঁধে দেয় প্রশাসন। পাশাপাশি হল ত্যাগ না করলে প্রচলিত নিয়মে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়। মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর পূর্বে আবাসিক হলে আসন নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানায় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। এ লক্ষে গত বৃহস্পতিবার থেকেই নবীন শিক্ষার্থীদের নতুন প্রস্তুত করা হয় সদ্য খালি হওয়া কক্ষগুলো। এছাড়া নবীনদের বরণে হল প্রশাসনের প্রস্তুতি দেখতে শুক্রবার রাতে আবাসিক হলগুলো পরিদর্শন করে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ^বিদ্যালয়ের উপ—উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, ‘রবিবার থেকে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাশ শুরু হচ্ছে। আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী শুরুর দিন থেকে নিজ নিজ আসনের দাবি রাখে। এবছর কোনো শিক্ষার্থী যেন আবাসন সংকটে না থাকে সেই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কঠোর।’

এদিকে, র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিতেও নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার প্রক্টর অফিস প্রদত্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮ এর ৫(৬) ধারা অনুসারে- বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিভাগ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায় Tease (টীজ)/র‍্যাগিং/নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা যাবে না। র‍্যাগিং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী র‍্যাগিং এর সর্বোচ্চ শাস্তি সাময়িক হতে চিরতরে বহিষ্কার।

শনিবার সরেজমিনে আবাসিক হলগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে কলম ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিচ্ছে হল প্রশাসন। হলটিতে বরাদ্দ পাওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আসন নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানান প্রাধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল রকীব। প্রভোস্ট অফিসে নিজের নামের পাশে স্বাক্ষর করে কক্ষের চাবি বুঝে পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। পরক্ষণেই হলের একজন স্টাফ এসে নিয়ে যাচ্ছেন নির্ধারিত কক্ষে। শিক্ষার্থীরা কেউ একা এলেও, অনেকের সাথে এসেছেন পিতা—মাতা, ভাই—বোন। তারাও সন্তানের জন্য নির্ধারিত হওয়া কক্ষটি একনজরে দেখে আসছেন। একই অবস্থা অন্যান্য হলগুলোতেও।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আসন নিশ্চিত হয়েছে প্রথম বর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলামের। তার পিতা নাজমুল হুদা সেলিম বলেন, ‘ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই হলে সিট পাইছে। আমি খুবই খুশি। আগে শুনছি একটা সিটের জন্য সিনিয়রদের পিছনে পিছনে ঘুরতে হইতো, গণরুমে থাকা লাগতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টাই গেছে। আমি এখন চিন্তামুক্ত। সে ঠিকমতো পড়ালেখা করলেই হলো।’

শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ হলের ৪২৫ নং কক্ষে বরাদ্দ পাওয়া জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার শাহরিয়ার মাহি বলেন, ‘প্রথম দিনেই এসে সিট পেয়েছি। ক্যাম্পাসে আসার আগে কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম। অনেকেই বলছিলো গণরুমেই থাকতে হবে কিছুদিন। কিন্তু আসার পর শঙ্কা কেটে গেছে। হলে আসতেই প্রভোস্ট অফিস থেকে রুম বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’

শেখ হাসিনা হলে আসন বরাদ্দ পাওয়া শিক্ষার্থী নাবিলা বিনতে হারুন বলেন, ‘আগামীকাল আমাদের ক্লাস শুরু হবে। তার ঠিক একদিন আগেই আমরা হলে উঠতে পারলাম। গণরুম জটিলতা, র‌্যাগিং নিয়ে ভয় বা সংশয় থাকলেও এর কিছুই পাইনি। আমরা নির্ধারিত এলোটেড হলে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই সিটে উঠতে পেরেছি। সব মিলিয়ে অসাধারণ অনুভূতি, যেন এক উৎসব মুখর পরিবেশ চারপাশে।’

বিশ^বিদ্যালয়ের হল প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘৫৩ ব্যাচকে হলে উঠানোর মধ্য দিয়ে একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হলো। বিগত বহুবছর ধরে যে গনরুমের সংস্কৃতি ছিল, আমরা এবার তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছি। প্রতিটি শিক্ষার্থী হলে উঠার সাথেই সাথেই তারা তাদের সিট পেয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছে।’

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘নবীন শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে প্রথম দিনেই সিট পাবে—এটা তাদের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান প্রশাসন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আবাসিক হলে এবং এ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতেও শিক্ষার্থীদের সুযোগ—সুবিধা বৃদ্ধি করতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করবে।

রিয়াদ

×