ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

বত্রিশ বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

বিপ্লব হোসেন

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্তির দিক দিয়ে এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ও। ১৯৯২ সালে কার্যক্রম শুরু করে ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার পথচলার বত্রিশ বছরে পদার্পণ করছে। তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে এখনো সময়োপযোগী মানসম্মত শিক্ষা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার বত্রিশ বর্ষপূর্তিতে বর্তমান প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা? জানিয়েছেন- বিপ্লব হোসেন

সেশনজট নিরসন হোক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা স্তরের অন্যতম বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাড়তি চাপ কমাতে ও অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আবর্তিত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে সেশনজট। সেশনজটের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনে আজ বিপর্যয় নেমে এসেছে।

এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিতি, কারিগরি শিক্ষায় অনগ্রসরতা এবং ক্লাস ও অবকাঠামোগত সমস্যা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন প্রাণ ফিরে পাবে।
এস.এম.রাহমান জিকু
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

তিন দশকেও বাড়েনি শিক্ষার মান
১৯৯২ সালে শিক্ষার মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও গত ত্রিশ বছরেও বাড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান। শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো বিশেষ উদ্যোগেরও দেখা মেলেনি এতদিনে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যথাযথ দক্ষ শিক্ষক না থাকায় ২৮ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এমনও শিক্ষার্থী আছেÑ যারা এখনো একটি মেইল কিভাবে করতে হয় জানে না।

এর দায়ভার কে নিবে? শিক্ষার মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বরং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এখনো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়া শিক্ষার্থীদের গত ত্রিশ বছরের প্রাপ্তির খাতায় রয়েছে শুধুই হতাশা। তাই বলতে হচ্ছে, এবার বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।
লাইজু আক্তার
শিক্ষার্থী, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ

হাতেকলমে শিক্ষায় জোর দিতে হবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তিন দশক অতিক্রম করার পরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রতিবন্ধকতা এখনো বিদ্যমান। তার মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামোগত সমস্যা এবং সময় উপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত না করা। এছাড়াও মানসম্মত শিক্ষক এবং কারিগরি শিক্ষার অভাব তো আছেই। অধিকাংশ ক্যাম্পাসে নেই ক্যারিয়ার ডেভেলপ করার মতো মতো ক্লাব। এতে করে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার বাইরে আর কিছুই শিখতে পারছে না।

যেখানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই  শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের একটা উপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি দিতেই ব্যর্থ। তবে ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কিছুই পরিবর্তনের পদেক্ষপ নিচ্ছে যেটি আমাদের জন্য ইতিবাচক। শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে।
মো. রাকিব
শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম

নিয়মিত সমাবর্তন হোক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অন্যতম একটি দাবি হচ্ছে সমাবর্তন। যা অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারছে না। ৩০ পেরিয়ে ৩১ বছরে পা রাখবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এই ৩০ বছরে একটি মাত্র সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাও ২৫ বছর পর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক আচার্য ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ খানের উপস্থিতিতে এই সমাবর্তনটি হয়েছিল। এরপর থেকে আর সমাবর্তনের কোনো নাম-গন্ধ নেই।

অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও অধিকার আছে সমাবর্তন পালন করার। তারাও স্বপ্ন দেখে মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে কালো ড্রেস পরে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেÑ তা দেশের মানুষকে জানান দিতে। তাই আমাদের উপাচার্য মহোদয়ের নিকট আর্জিÑ এই বিষয়টির প্রতি যেন গভীরভাবে নজর দেওয়া হয়।
আজহার মাহমুদ
শিক্ষার্থী, ওমরগনি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম

শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি উন্নত করতে হবে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। একশ’ বা দেড়শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের যেমন নিবিড় যতœ নেয় তেমনি পঞ্চাশ বা ষাট বছরের পুরনো কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের যতœ নিতে পারে না। এই জন্য দায়ী করা যেতে পারে অবকাঠামো সমস্যাকে। শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক বা শিক্ষাউপকরণের অভাবে অনেক কলেজে ঠিকমতো সিলেবাসও কমপ্লিট হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বারো মাসই যেন পরীক্ষার উৎসব।

শিক্ষার্থীরা কোনো রকম বাজারে চলতি সাজেশন আর গাইড কিনে হাতে গোনা কয়েকটা প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয় শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের উদ্দেশ্যে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি ভয়াবহ দুর্বলতার দিক পরীক্ষার খাতার মূল্যায়ন। অনেকেই ভালো পরীক্ষা দিয়েও আশানুরূপ সাফল্য পায় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু শিক্ষাদান ও মূল্যায়নে নজর দিতে হবে। 
জাবিন তাসনীম খান
শিক্ষার্থী, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ, রাজশাহী 

লক্ষ্য হোক দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত ও স্মার্ট জাতি গঠনের
কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের আলোকে ১৯৯২ সালে ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বড় ভরসা এই প্রতিষ্ঠান। তবে সম্ভাবনাময় এই প্রতিষ্ঠানটি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সৃষ্টলগ্ন থেকেই। উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম মানদ- অনুসরণ করা হয় না এখানে।

পর্যাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, বই কিংবা ল্যাবের যন্ত্রপাতি সবই প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। এসব সংকট দূর করে কার্যকর ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিশ্বমানের পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত ও স্মার্ট একটি জাতি গঠিত গঠন সম্ভব হবে।
এস আর শাহিন
শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ

স্বপ্ন পূরণের সারথি হোক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
বিদ্যার্থী তালিকাভুক্তি অনুসারে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণের পথে পা বাড়ায়। তবে কিছু শিক্ষার্থী স্বপ্নের আকাশ ছুঁয়ে দেখতে পারলেও, কিছু শিক্ষার্থীর স্বপ্ন শুধু জীবনের না পাওয়া এক অধ্যায় হয়ে থেকে যায়। আর এর জন্য মূলত দায়ী করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার নিয়ম-কানুনকে। বর্তমানে এখানে অধ্যয়নরত অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মতে, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বেকার তৈরির কারখানা, এখানে মেধার কোনো মূল্যায়ন করা হয় না’। কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন নিয়ে আসা এখন সকল শিক্ষার্থীর দাবি।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সবার স্বপ্নের নাম না হলেও যারা এর অধীনে ভর্তি হয় তাদের কাছে স্বপ্নের মতোই। উচ্চশিক্ষার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই চাকরির বাজারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নাম শুনে আগেই ধারণা তৈরি হয়ে যায় যে ক্যান্ডিডেটটা কতটা মেধাবী, আর যোগ্য হবে। সুযোগ না দিয়েই বিচার করে ফেলার এই প্রবণতার পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আলো ছড়াতে পারে অনায়াসে। শুধু যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলছে অনেকেই। প্রত্যাশা প্রাপ্তির পাল্লা ভারি করতে গিয়ে হতাশা, দুশ্চিন্তা, বেকারত্বের পাল্লা ভারি হচ্ছে রোজ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেশনজট, অবহেলা, অবমূল্যায়ন এই শব্দগুলো মুছে যাক। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসুক।
তামান্না আক্তার
শিক্ষার্থী, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ

×