বাড়ছে না আশানুরূপ রাজস্ব
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। এর মধ্যে টিআইএনধারী রয়েছেন মাত্র ৭৯ লাখ। বছর শেষে রিটার্ন জমা দেয় মাত্র ২৫ লাখের মতো। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত আফগানিস্তানে। সেখানে জিডিপির অনুপাতে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো কর আসে। এরপরই অবস্থান বাংলাদেশের। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে জিডিপির অনুপাতে মোট ২১ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
বর্তমানে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এই অনুপাত বাড়াতে হলে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত থাকা প্রয়োজন। বিগত অর্থবছরে ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। যেসব প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমার রসিদ যাচাই না করে সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধানও রয়েছে।
তবে করনীতি যথাযথ বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কতটা তৎপর রয়েছে জানা নেই। একটি দেশের উন্নয়নে করের আওতা বাড়ানো এবং কর আদায় নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়লেও রাজস্ব আদায় বাড়ছে না আশানুরূপ। করনীতিতে রয়েছে, বছরে তিন লাখের বেশি আয় করলে আয়কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪ কোটির বেশি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে অধিক সংখ্যক মানুষ নি¤œ মধ্যবিত্তের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে যারা আছে, তাদের আয় ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ ধরা হয়। মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী এখন এই আয় যদি ৫০ হাজার থেকেও ধরা হয়, এরপরও মধ্যবিত্তের সংখ্যা আনুমানিক ২ কোটির বেশি হবে। অথচ আমাদের রিটার্ন জমা হয় ২৫ লাখের মতো। যারা টিআইএনধারী আছেন, তারাও কর প্রদান করছেন না নিয়মিত। কর প্রদানে অনীহা এবং প্রতিবছর কর দেওয়াকে অনেকেই বাড়তি ব্যয় অথবা ঝামেলা মনে করেন।
দেশের স্বার্থে কর দেব, দেশকে আরও উন্নত করতে কর দেব। এমন মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। শুধু দেশকে ভালোবাসলেই হবে না। সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখাও প্রয়োজন। রাজস্ব আয়ে যেসব নির্দেশনা রয়েছে, তার সঠিক বাস্তবায়ন হলে কর আদায় আগের তুলনায় অনেক বাড়বে বলে আশা করা যায়।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ লোক রাজস্ব প্রদান করে, যেখানে ভারতে এ হার ২৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজস্ব আহরণের হার বাড়াতে নিজেদের করজাল সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি অভিমত দেন।
রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান আরও বলেছেন, আমাদের মোট রাজস্বের সিংহভাগই আসে বিদ্যমান করদাতাদের কাছ থেকে এবং সমাজের একটি বড় অংশই করজালের বাইরে থেকে যাচ্ছে, ফলে চাপ বাড়ছে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর। এমতাবস্থায় করজাল সম্প্রসারণ করা সম্ভব না হলে বিদ্যমান করদাতারা কর দেওয়ায় নিরুৎসাহিত হবেন, তাই করজাল সম্প্রসারণে এনবিআর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগামী ৬ মাস কাজ করবে।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, ‘দেশের জটিল রাজস্ব কাঠামোর জন্য আমাদের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনায় নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তাই এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিকাশে সহায়ক এবং সহজ রাজস্ব কাঠামো প্রণয়নের ওপর জোরারোপ করেছেন। বিদ্যমান কর হার না বাড়িয়ে, করজাল সম্প্রসারণের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।
বর্তমান আইনে ব্যবসায়িক ক্ষতিকে অন্যান্য ব্যবসায়িক উৎসের আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারলে ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা আরোপিত হয়। এ লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ধারা ৩৭-এর অনুরূপ বিধান পুনর্বহালের প্রস্তাব করেছেন। কর প্রদান ও করসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি সহজীকরণের লক্ষ্যে আয়কর ব্যবস্থাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার ওপর জোরারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
আজকাল গ্রামীণ এলাকায় অনেক কোটিপতি রয়েছেন, যাদের কর প্রদানে রয়েছে অনীহা। তাই শহরের পাশাপাশি গ্রামেও করের জাল বিস্তারে তাদের স্বপ্রণোদিতভাবে কর প্রদানে উৎসাহিত করতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কর অব্যাহতি প্রথা বাতিল করা প্রয়োজন। একজন রিক্সাচালকও মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থিরমূল্যে জিডিপির আকার ছিল সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। দশ বছরে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে মূল্য সংযোজন দ্বিগুণ হয়েছে। মাথাপিছু গড় আয়ও বেড়েছে। অথচ করদাতার সংখ্যা বাড়েনি। প্রতিবছরই এনবিআর টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিলেও কর আদায়ে তেমন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রিটার্ন জমার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো আবশ্যক। এছাড়াও করের হার যৌক্তিকীকরণের এবং রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতিও সহজ করা সময়ের দাবি।