ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

৫শ’ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা

ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করবে ওয়ান ফার্মা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২১:১১, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করবে ওয়ান ফার্মা

বাংলাদেশ বিশ্বে ওষুধ উৎপাদনে ৭২তম

বাংলাদেশ বিশ্বে ওষুধ উৎপাদনে ৭২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ম হলেও ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ কিনতে এদেশের মানুষকে এখনো হিমশিম খেতে হয়। ফলে এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। এবার দেশেই এই দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ উৎপাদন করে সুলভমূল্যে মানুষের মাঝে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে ওয়ান ফার্মা লিমিটেড।

এ লক্ষ্যে প্লান্ট স্থাপন ও মেশিনারিজ আমদানিতে ৫শ’ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি বগুড়ায় ওয়ান ফার্মার কারখানা পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকে বিষয়টি অবগত করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এমনকি বিশ্বের ১০০টি দেশে রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে বলে এ সময় জানানো হয়। 
সংশ্লিষ্টদের মতে, ওয়ান ফার্মার ওষুধ শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রতিবেশী আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাসহ ১০টি দেশে রপ্তানির উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আগামী ২-৩ বছরের মধ্যেই এই দেশগুলোতে ওষুধ রপ্তানি করা হবে। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে ২ মিলিয়ন ও মিয়ানমারে ৫০ হাজার ডলারের ওষুধ রপ্তানি করা হয়েছে। এছাড়া ক্রয়াদেশ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা থেকেও। অপরদিকে আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া থেকেও ওয়ান ফার্মার ওষুধ আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।   
ওয়ান ফার্মার প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা (সিটিও) ইশতিয়াক আহমেদ জানান, আলজেরিয়া তাদের কোম্পানির ওষুধ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশটির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এখন প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ চলছে। এটি শেষ হলেই রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এছাড়া আফ্রিকার বাইরে অনুন্নত দেশগুলোতেও ওষুধ রপ্তানির পরিধি বাড়ানো যাবে বলে তিনি মনে করেন। ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, দেশের বিভিন্ন কোম্পানি এখন ওষুধ রপ্তানির বাজার ধরছে।

আমাদের কোম্পানি ১০০টি দেশে রপ্তানির টার্গেট নিয়ে কাজ করছে। আগামী ২ থেকে ৩ বছরে ১০ দেশে রপ্তানি করতে চাই। বর্তমানে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে রপ্তানি হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা থেকে রপ্তানি আদেশ দিয়েছে। এই তিন দেশে এখন রপ্তানি হচ্ছে। ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরীতে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। ২০১৮ সাল থেকে ওষুধ রপ্তানি শুরু করে ওয়ান ফার্মা। ২০২৪ সালে ২ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ আফগানিস্তানে রপ্তানি করেছে। চলতি বছরে ৩ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার আছে। এছাড়া মিয়ানমারে ৫০ হাজার ডলারের রপ্তানি হয়েছে। এই ওষুধ কোম্পানিটির বার্ষিক টার্নওভার ১৫০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা। গত বছরে এই কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ৬১ শতাংশ ছিল বলে দাবি করেছেন এক কর্মকর্তা। বর্তমানে এই কারখানায় ২০০ শ্রমিক কাজ করছে। কারখানাটিতে স্টোরয়েড ও বায়োটেকসহ শতাধিক জেনেরিকের ওষুধ তৈরি করছে ওয়ান ফার্মা। 
এ বিষয়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান নাজমুন নাহার বলেন, আমদানির পরিবর্তে আমাদের কোম্পানি দেশেই ওষুধ তৈরি করছে, ফলে সাধারণ মানুষকে কম দামে ওষুধ সরবরাহ করতে পারছি। আমরা আমদানির বিকল্প ওষুধ বাজারে দিতে সক্ষম হয়েছি, এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের ওষুধের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। আমরা চাই সামনের দিনগুলোতে ভালো কোম্পানির ওষুধের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কম দামে বাজারে ওষুধ দিতে। আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে আমরা ভালো মানের ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছি।
ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনের বিষয়ে জানা গেছে, কোম্পানিটি ওষুধের উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের দিকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের বড় অংশ ব্যয় হবে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনে। প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন শুরু হলে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 
বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান ক্যান্সারের বায়োটেক ওষুধ তৈরির প্লান্ট স্থাপন করছে। ইতোমধ্যে কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে, আরও যন্ত্রপাতি আসছে। এগুলো স্থাপন করে দেশে তৈরি ক্যান্সারের ওষুধ বাজারে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশে ক্যান্সারের ওষুধ এখন বেশ ব্যয়বহুল। আমরা উৎপাদন শুরু করলে এই ওষুধ গরিব মানুষ কম দামে পাবে এবং তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আমরা আরও কিছু চুক্তি সই করার পরিকল্পনা করছি।
তবে এই রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আছে বলে তিনি মনে করেন। নাজমুন নাহার বলেন, সম্ভাবনাময় এই খাতে এখনো বেশকিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। জাতীয় পর্যায়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এসব সমস্যার কারণে অনেক বেশি সময় ব্যয় হয়। এই সমস্যাগুলো নিরসণ করা গেলে সম্ভাবনাময় ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল হতে পারে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদসহ ওষুধ কোম্পানি আছে ৯০৫টি। এর মধ্যে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি ৩০৫টির বিপরীতে চালু আছে ২২৯টি। অপরদিকে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৬৪টি কারখানা নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে।

এই কারখানাগুলোতে প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসনের মতে, বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে উত্তরোত্তর উন্নতি করেছে। দেশে উৎপাদিত প্রায় সব ওষুধই রপ্তানি হচ্ছে। উৎপাদিত এসব ওষুধ রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে সরকার অনেক দিন থেকেই প্রণোদনা দিয়ে আসছে।

×