
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। নানা প্রচেষ্টার ফলে রিজার্ভ বাড়ায়, ধীরে ধীরে ফিরছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। তবে উন্নত দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। সেই সকল দেশের প্রবাসীরা ব্যক্তি জীবনে কোনো প্রকার ভোগ বিলাসিতা না করে উপার্জিত টাকা পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দেন। যে কারণে স্বল্প বেতনের প্রবাসীরা অনেক বেশি পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
তবে বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বেশিভাগ আসছে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের ১০ দেশ থেকে। বিশেজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দিকে একমুখী না হয়ে নতুন নতুন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নজর দিতে হবে। অবশ্য সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর রেমিটেন্স প্রবাহের ধারা ইতিবাচক থাকায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বহির্বিশ্বে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এ ছাড়া প্রতিবছর আসা বিপুল রপ্তানি আয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে। তবে রেমিটেন্সের সিংহভাগ আসে মাত্র ১০টি দেশ থেকে। আরও ১৫টি দেশ থেকে স্বল্প পরিমাণের রেমিটেন্স এলেও বাকি দেশ থেকে আসা প্রবাসী আয় খুবই সামান্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
তথ্য বলছে, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের সেরা ১০টি দেশ থেকে মোট রেমিটেন্সের ৮৮. ৫২ শতাংশ আসে। আরও ১৫টি দেশ থেকে আসে ১০ শতাংশ এবং অন্যদেশ গুলো থেকে ২ শতাংশ রেমিটেন্স দেশে আসে। দেশে রেমিটেন্স আসা শীর্ষ ১০ দেশগুলো হলো- আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত, ইতালি, কাতার ও সিঙ্গাপুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শুধু মার্চ মাসে দেশে মোট রেমিটেন্স এসেছে ৩২৯৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশ থেকে এসেছে ২৯১৭ কোটি ডলার বা ৮৮ শতাংশ। এখন ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.৭৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৭৩ কোটি ডলার। তবে আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম-৬) অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২১.৩৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৩৯ কোটি ডলার।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠান সৌদি আরবের প্রবাসীরা। তবে বর্তমানে দেশটি পিছিয়ে তিন নাম্বারে চলে গেছে। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী থাকলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোর প্রবণতা বেশি। তাই মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ আরব আমিরাত রেমিটেন্স প্রেরণে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে পাচারকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারাও রেমিটেন্স পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের অনেকে এক দেশ থেকে রেমিটেন্সের টাকা সংগ্রহের পর বিনিয়োগ করছেন আরেক দেশের বিভিন্ন খাতে। অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে পরিবারসহ বাস করছেন। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহসহ ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে তাদের সম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। তারা এই চাহিদা পূরণ করছেন হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে ও প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দীক জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক প্রবাসী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠান। প্রথমদিকে বিদেশে যাওয়ার খরচ বাবদ ঋণের একটি অংশ পরিশোধের চেষ্টা করেন। যে কারণে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সব ধরনের অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।
জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি জনশক্তি রপ্তানি করে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। সৌদিতে বাংলাদেশী কর্মী (জনশক্তি) নিয়োগে কোটা বৃদ্ধি এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার খুলে দেওয়ার ফলে জনশক্তি রপ্তানির এই রেকর্ড সম্ভব হয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের ১৩ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। হিসাব অনুযায়ী ৩১টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে না।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর কারণেই প্রবাসীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। যে কারণে তারা সহজেই দেশে টাকা পঠাতে পারছেন। তবে অনেকেই আছেন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে রিজার্ভের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। তা ছাড়া কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে একমুখী না হয়ে নতুন নতুন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নজর দিতে হবে।
তবে সকল দেশ থেকে বেশি রেমিটেন্স আসছে, এই সকল দেশের কর্মীদের মাসিক বেতন অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এর পরও তারাই বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, আমরা ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে মেলার মাধ্যমে ক্যাম্পেন করে আসছি। ২.৫ শতাংশ প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে। এ ছাড়া আপনারা জানেন, কিছু কিছু দেশের শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে থাকে।
তারা ব্যাক্তিগত জীবনে কোনো প্রকার ভোগ বিলাস না করে উপার্জিত অর্থ পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দেন। যে কারণে অল্প বেতনের প্রবাসীরা অনেক বেশি টাকা দেশে পাঠিয়ে থাকে। অন্যদিকে ইউরোপসহ উন্নত দেশের প্রবাসীরা পরিবার নিয়ে স্থাীয়ভাবে বসবাস করে থাকেন যে কারণে তারা নিজ দেশে টাকা পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেন না।
রুপালী ব্যাংকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের যে তথ্য দেখা যায় তা ওই দেশের প্রবাসীদের পাঠানো টাকা নাও হতে পারে। রেমিটেন্স মূলত বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে পাঠানো হয়। কোম্পানির এজেন্টগুলো মার্কেটিং করে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। তবে এটি সত্য উন্নত দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে।