ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দেড় দশক

সিন্ডিকেটের করাল গ্রাসে সরকারি কেনাকাটা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

সিন্ডিকেটের করাল গ্রাসে সরকারি কেনাকাটা

সিন্ডিকেটের করাল গ্রাসে সরকারি কেনাকাটা

সরকারি অর্থে পরিচালিত কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এক যুগ আগে চালু হয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পদ্ধতি। উদ্দেশ্য ছিল ঠিকাদারি কার্যক্রমে দুর্নীতিরোধ, সবার জন্য সমান সুযোগ এবং স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তি বদলালেও রয়ে গেছে আগের সেই ‘ঘরের মানুষ’ নির্ভরতা।

পরিসংখ্যান বলছে, ই-জিপির আওতায় ব্যয়িত প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকার মধ্যে ৬১ শতাংশ কাজই পেয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ ঠিকাদার। আর এই পাঁচ শতাংশের ভেতরেই আছে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফায়ার সার্ভিসে দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্যকারী প্রতিষ্ঠান ফন (ঋঅডঘ) ইন্টারন্যাশনাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত  দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৪টি কেনাকাটা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে ই-জিপির মাধ্যমে। এতে মোট খরচ হয়েছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। আর এই বিপুল অর্থের ৬১.৩১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে মাত্র শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের হাতে। অন্যদিকে সর্বনি¤œœ ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারিত্ব সব মন্ত্রণালয় মিলে ১ শতাংশেরও কম।

টিআইবির ভাষ্যমতে, ‘সরকারি কেনাকাটায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সরকারি ক্রয় খাত কার্যত এক ধরনের জিম্মি দশায় রয়েছে।’ এছাড়া শীর্ষ মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেই দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ। গবেষণা অনুযায়ী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৩৫ জন ঠিকাদার প্রায় ৭৩ শতাংশ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩৮ জন ঠিকাদার ৩১ শতাংশ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৮১ জন ঠিকাদার ৩২ শতাংশ, এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে ২৯৪ জন ঠিকাদার প্রায় ২৮ শতাংশ বাজারদখল করে আছে। ফায়ার সার্ভিসে এই দখলদারিত্ব এতটাই গভীর যে, টিআইবি তাদের গবেষণায় ফন ইন্টারন্যাশনালকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ফায়ার সার্ভিসে ‘ফন ইন্টারন্যাশনাল’-এর দীর্ঘ একচেটিয়া বাণিজ্য ॥ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কেনাকাটায় বিগত দেড় দশক ধরে এককভাবে কাজ করে আসছে ফন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি এমনভাবে টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করে যেখানে কেবল তাদেরই অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। বছরের পর বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসের শত শত কোটি টাকার গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ১৮টি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে ৭৮ শতাংশ কাজ পেয়েছে ফন ইন্টারন্যাশনাল। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০৪ কোটি টাকা। তবে, অন্যান্য সূত্র মতে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর ৫০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার গাড়ি, পাম্প ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। ফায়ার সার্ভিসে দুর্নীতির অভিযোগ শুধু কেনাকাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

অভিযোগ রয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ফন ইন্টারন্যাশনাল ১২ কোটি টাকার কোটেশন করে কোনো কাজ না করেই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। কেন্দ্রীয় স্টোর থেকে কাজ না করে কোটেশন বিল উত্তোলন এবং নীতিবিরোধীভাবে টেন্ডার অনুমোদন এসবই ছিল তাদের রুটিন কৌশল। এছাড়া নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, মানি লন্ডারিং, টেন্ডারবাজি ও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের অনুগতদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার মতো নানা অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বিশ্লেষকদের মতে, এমন একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এবং তার ভাই নূর উদ্দিন আনিসের সঙ্গে ফন ইন্টারন্যাশনালের সরাসরি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তথ্য বলছে, কাজ যত বড়, কমিশনের অঙ্ক ততই বিশাল। এই সম্পর্ক গড়ে উঠে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, এবং এখন সরকার পরিবর্তনের পর ফন ইন্টারন্যাশনাল, নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টায় লিপ্ত। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি কেনাকাটায় সবাই আশা করেছিল ই-জিপির মাধ্যমে স্বচ্ছতা আসবে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, শুধু কাগজে কলমে ডিজিটাল হয়েছে, মূলত পুরোনো সিন্ডিকেট এখন ডিজিটাল রূপে বহাল তবিয়তে চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসে টেন্ডারবাজি ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে। তবে এই তদন্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এদিকে, ফন ইন্টারন্যাশনালের সিইও মাহমুদ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা অগ্নি নিরাপত্তা অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমে কার্যকর ব্যবসা মডেল গড়তে চাই।’ তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ফন ইন্টারন্যাশনাল ১৯৮০ সালে একক মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি শাখা পরিচালনা করছে। তারা নিজেদেরকে দেশের অগ্নি নিরাপত্তা খাতে ‘অগ্রণী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে দাবি করে। ফায়ার সার্ভিসের মতো মানবিক ও জরুরি খাত, যেখানে প্রতিটি সেকেন্ডে জীবন রক্ষা নির্ভর করে সরঞ্জামের মান ও গতি-ব্যবস্থার ওপর।

সেখানে একক প্রতিষ্ঠানকে বছরের পর বছর শত শত কোটি টাকার কাজ দেওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যদি সরকার প্রকৃতপক্ষে ই-জিপিকে স্বচ্ছ করতে চায়, তাহলে টেন্ডার প্রক্রিয়ার শর্তাদিতে পরিবর্তন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। নচেৎ সরকারি অর্থে দুর্নীতির এই মহোৎসব চলতেই থাকবে। আর জনগণের টাকায় তৈরি হবে দুর্নীতির দুর্গ, ফায়ার সার্ভিসের মতো একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও হয়ে উঠবে ক্ষমতাবানদের ব্যক্তিগত আয়ের উৎস।

×