
পুঁজি উত্তোলনের জন্য বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার গঠন
পুঁজি উত্তোলনের জন্য বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার গঠন করা হলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে বিগত ৮ মাসে কোনো কোম্পানিকে আইপিও দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওপর ইস্যু ম্যানেজার ও উদ্যোক্তারা পুরো মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনে কোনো আইপিও ফাইল জমা নেই।
রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের ওপর শুরু থেকেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট কারওই আস্থা নেই। সারাদেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বর্তমান কমিশন অযোগ্য। তারা শেয়ারবাজার বুঝেন না। এই বাজারে আইপিও’র গুরুত্ব অনুধাবন করার মতো অবস্থায় তারা নেই। তাদের এই অবস্থা ইস্যু ম্যানেজার এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যেও পরিষ্কার। তাই তারাও শেয়ারবাজারে আইপিওতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
শুধুমাত্র বাজার সংশ্লিষ্টরাই রাশেদ মাকসুদের প্রতি অনাস্থাশীল, তা নয়। স্বয়ং কমিশনের কর্মকর্তারাই য্যোগতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সম্প্রতি বিএসইসির ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অনেক সমস্যার মধ্যে তাদের ওপর আস্থার সংকটের কারণে গত ৮ মাসে মৌলভিত্তিক কোনো কোম্পানি শেয়ার বাজারে আসার আগ্রহ দেখায়নি।
এতে শেয়ার বাজার নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বর্তমান কমিশন কোনো ইস্যু অনুমোদন না করে বাতিল করার বিষয়েই বেশি আগ্রহী। দেখা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পরে শেয়ারবাজারে কোনো আইপিও আসেনি।
আইপিওতে ধস ॥ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সাল পরপর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও। তবে রাশেদ মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহণের পরে সেটা শূন্যতে নেমে এসেছে।
২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ এবং টেকনো ড্রাগস। এ চার কোম্পানির মধ্যে এনআরবি ব্যাংক স্থির-মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। বাকি তিনটি কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে এসেছে।
এনআরবি ব্যাংক আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বাকি তিন কোম্পানির মধ্যে বেস্ট হোল্ডিং ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ৯৫ কোটি এবং টেকনো ড্রাগস ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। অর্থাৎ চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে মোট ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।
এর আগে ২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, শিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। অর্থাৎ ২০২৩ সালে তিনটি কোম্পানি এবং একটি মিউচুয়াল ফান্ড আইপিওতে আসে। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা, শিকদার ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। অর্থাৎ চারটি প্রতিষ্ঠানের উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি টাকা।
পরপর দুই বছর মাত্র ৪টি করে প্রতিষ্ঠান আইপিওতে এলেও ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। অবশ্য ২০২২ সালের আগের তথ্য দেখলে শেষ দুই বছরের আইপিওর চিত্র খুবই হতাশাজনক। কারণ ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫টি।
আইপিও কম আসার কারণ ॥ আইপিও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, ৮ মাসে কোনো প্রতিষ্ঠানের আইপিও না আসা অস্বাভাবিক। আইপিও প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য হওয়া আইপিও কম আসার অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে। বাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে পলিসিগত যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আইপিও ছাড়া একটি শেয়ারবাজার হয়ে গেছে। আইপিও ছাড়া শেয়ারবাজার কোনো শেয়ারবাজার নয়। আইপিও আনতেই হবে, এর বিকল্প কোনো চিন্তা করা যায় না। আমরা মনে করি আইপিওর যে প্রক্রিয়া, সেটি যারা আইপিওতে আসতে চায় তাদের জন্য কমফোর্টেবল (স্বাচ্ছন্দ্য) নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সমস্যা কোথায় সেটা বের করা এবং দ্রুত তার সমাধান করতে হবে।
ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে হবে প্রণোদনা দিয়ে ॥ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, অতীতে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে ওপর মহল থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়নি। একটা বিষয়ে এখানে কোনো ইনসেনটিভ নেই। তাহলে ভালো কোম্পানি আসবে কেন? এটা নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, ওরা এটা দেখবে।