ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

ড্যাপ সংশোধন না হওয়ায় আবাসনখাত স্থবির: সংকটে দুই শতাধিক লিংকেজ শিল্প

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৩:২১, ২২ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৪:৩৯, ২২ এপ্রিল ২০২৫

ড্যাপ সংশোধন না হওয়ায় আবাসনখাত স্থবির: সংকটে দুই শতাধিক লিংকেজ শিল্প

ছবি: জনকণ্ঠ

ড্যাপ সংশোধন না হওয়ায় আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে আবাসন খাতে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় চাপের মুখে পড়েছে দুই শতাধিক লিংকেজ শিল্প। এসব শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষ করে রড, সিমেন্ট, ইট, টাইলস, কেবল, রং, লিফট, থাই, স্যানেটারিসহ সকল খাত চাপের মুখে পড়েছে। এই সংকট উত্তরণে দ্রুত ড্যাপ সংশোধনের তাগিদ দিয়েছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা।


মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন- রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায়, ইলেকট্রানিক ইকুইপমেন্ট এ্যান্ড সিকিউরিটি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট  মো. নিয়াজ আলী চিশতি, বাংলাদেশ এলিভেটর এক্সেলেটর অ্যান্ড লিফট ইম্পোটার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট  জনাব এমদাদ উর রহমান, বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ, বাংলাদেশ গ্যাস মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. হোসেন আলমগীর, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল ক্যাবলস্ ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ সভাপতি মো. আকতার হোসেন ঢালী, বাংলাদেশ টিম্বার ইমপোর্টাস এ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের তানভীর মোহাম্মদ দিপু এবং রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পরিচালক জনাব মুহাম্মদ লাবিব বিল্লাহ প্রমুখ।

রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদুজ্জামান লিখিত বক্তব্যে বলেন, অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। ৪০ লক্ষ নাগরিকের কর্মসংস্থান এবং ২ কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই গৃহায়ন শিল্পকে ঘিরে। জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রয়েছে এই খাতের।


তিনি বলেন, মৌলিক চাহিদার অন্যতম গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে সরকারের সাথে বড় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে আবাসন শিল্পের সদস্যদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করাই রিহ্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠান সমূহের লক্ষ্য। রিহ্যাব সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই আজ শহরগুলোতে সুন্দর সুন্দর নান্দনিক ভবন তৈরি হচ্ছে। আবাসন শিল্পের কার্যক্রমের উপর নির্ভর করে রড, সিমেন্ট, ইট, টাইলস, কেবল, রং, লিফট, থাই, স্যানেটারিসহ (সবার নাম বলতে পারছি না) প্রায় দুই শতাধিক এর অধিক লিংকেজ শিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। ৪০ লক্ষ নাগরিকের কর্মসংস্থান এবং ২ কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই গৃহায়ণ শিল্পকে ঘিরে। জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রয়েছে এই খাতের। রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট বলেন, আবাসনখাত ভালো থাকলে আমাদের সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকার কথা কিন্তু তারাও ভালো নেই। কারণ লিংকেজ শিল্পগুলোর সব শেষ ফিনিস প্রোডাক্ট এর বেশির ভাগ ক্রেতা ডেভেলপাররা। বৈষম্যমূলক ভ্যাপ (২০২২-২০৩৫) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন যাবৎ আবাসন শিল্প মারাত্মক সমস্যায় রয়েছে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে লিংকেজ শিল্পগুলোর উপর। ড্যাপে ফার (FAR) সমস্যাকে কেন্দ্র করে আমাদের ভবনের উচ্চতা এবং আয়তন একেবারে কমে গেছে। ফলে ২০২২ সালে ড্যাপ এর প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর জমির মালিকরা ডেভেলপ করার জন্য আমাদের কোন ভূমি দিচ্ছেন না। যার কারণে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নতুন কোন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এতে লিংকেজ শিল্পগুলোর পণ্যের চাহিদাও ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এখানে লিংকেজ শিল্পগুলোর নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে আপনারা পৃথকভাবে তাদের প্রশ্ন করতে পারবেন।

তিনি বলেন, নির্মাণ উপকরণের সব চেয়ে বড় উপাদান রড। সেই রডের চাহিদা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। গেল বছরের শেষের দিকে রড শিল্পের কয়েক টা সংগঠন যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল তাদের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এরপর গেল ৪-৫ মাসে রডের চাহিদা আরো কমেছে। একই ভাবে চাহিদা কমেছে সিমেন্ট, ইটসহ অন্যান্য উপকরণের। চাহিদা কমে যাবার কারণে কিছু কিছু পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে অনেকগুলো লিংকেজ শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ৩ শিফটের উৎপাদন ২ শিফটে নামিয়ে দিয়েছেন, আবার কেউ সেটা ১ শিফটে নামিয়ে এনেছেন। উৎপাদন কমানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থান এখানে সংকোচিত হয়েছে। অনেক লোকবল ছাঁটাই হয়েছে এবং অনেকে সেই পথে হাটছেন। এক কথায় বলতে গেলে বৈষম্যমুলক ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ফার (FAR) সংক্রান্ত সমস্যা এবং সরকারি বেসরকারি অবকাঠামোগত প্রকল্পের গতি কমে যাওয়াতে আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিতে মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে। তিনি  বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় আয়তনে অনেক ছোট এইদ দেশ। আর ঢাকা বিশ্বের জনবলে মেগা সিটি। অল্প প্রায়গার বেশি পরিমাণ লোকের আবাসনের ব্যবস্থা আমাদের করতে হচ্ছে বাস্তবতার কারণেই। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে জমি কম থাকায়। সব কিছু বিবেচনা করে এই সেক্টরের বিশেষজ্ঞগণ এবং সরকার অনেক যাচাই বাছাই সাপেক্ষে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ জারি করেন।

বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মদদপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬ কে উপেক্ষা করে ও মাষ্টার প্ল্যান-২০১০ কে অন্যায় ভাবে রহিত করে কেড়ে নেন ২০০৮ এর ফার অংশটুকু। সৃষ্টি করা হয় নগরবাসীর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য। এরপর থেকেই আমাদের প্রিয় রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে উন্নয়নে ধস নামে। স্থবির হয়ে যায় এই খাত সংশ্লিষ্ট অনেক শিল্প কারখানা। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। এই খাতের স্থবিরতা না কাটলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে এবং লক্ষ লক্ষ নাগরিক বেকার হবে এবং হচ্ছে। এই সব বেকার নাগরিক জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপকর্মে। ফলে আইন শৃংখলাতেই এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের স্বার্থেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে ভ্যাট-ট্যাক্স জনিত নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। সামনে আমাদের জাতীয় বাজেট ঘোষণা হবে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে যার যার মত করে দাবি পেশ করা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় বাজেটে এই বিষয় অব রাখতে হবে। আমরা চাই একটা বাস্তবধর্মী, জনবান্ধব ও ব্যাবসা বান্ধব বাজেট বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার জনগণকে উপহা দিক। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে বাজেট যাতে ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।


এছাড়া বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ নিয়ে ভূমি মালিক, আবাসন ব্যবসায়ী এবং এই সংক্রান্ত লিংকেজ শিল্পগুলোর বিনিয়োগকারীদেও মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। জমির মালিক এর পাশাপাশি ফ্ল্যাট ক্রেতা সবার মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার জন্য অবশ্যই আবাসন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির স্থবিরতা হতে অতিদ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে। সরকারের এ ব্যাপারে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। 

রবিউল হাসান

×