ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

 ২০২৪ সালে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ

টেকসই উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়লেও নেই দৃশ্যমান কাজ

নাজমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২২ এপ্রিল ২০২৫

টেকসই উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়লেও নেই দৃশ্যমান কাজ

দেশের অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশের প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত

দেশের অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশের প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘পরিবেশ দূষণ সামগ্রিক দিক থেকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্ষতি সাধন করছে। এতে আমাদের নেট প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের কারণে দেশের অর্থনীতি পিছিয়ে যাচ্ছে।’ 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ পরিবেশবান্ধব খাতে বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। সেইসঙ্গে মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে দিতে বলা হয়েছে। ২০২৪ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই খাতে মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থায়নের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে প্রতিবছরই টেকসই পরিবেশবান্ধব খাতে বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। এর পরেও টেকসই অর্থায়নে নেই দৃশ্যমান কাজ। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্প ইত্যাদি। 
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ‘সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ইউনিট’ গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টেকসই অর্থায়ন নীতি জারি করে। এর আলোকে প্রতিটি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করেছে। তারা গ্রাহকদের উৎপাদন চর্চায় পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অনুসরণ করছে। অর্থায়নের শর্তের সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয় যুক্ত করছে। গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ প্রদানের মানদ- অনুসরণে পরিবেশ এবং সামাজিক ঝুঁকি পরিপালন নিশ্চিত করছে।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ ও সামাজিক মূল্যায়ন করছে, যাতে উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কর্মকা-ে পরিবেশ দূষণ না হয়। বর্জ্য  পরিশোধনাগার (ইটিপি), নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয়ী প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হাইব্রিড বা বৈদ্যুতিক গাড়ি, সবুজ ভবন, সবুজ কারখানা ইত্যাদি খাতে তারা অর্থায়ন বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই খাতে মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থায়নের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ। যেখানে ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালে ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৭৬ কোটি বা ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ ছাড়াও ২০২৪ সালে সবুজ খাতে ঋণ বিতরণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ, যেখানে ২০২৩ সালে ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিগ্রস্ত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক খাতের অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং পরিবেশের প্রতি নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক বছরে এ ধরনের অর্থায়নে অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। সবুজ অর্থায়নের ভিত্তি গড়ে ওঠে মূলত ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার টেকসই উন্নয়ন এবং নিরাপদ শিল্প গঠনে বাধ্য হয়।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক একে একে নীতিমালা প্রণয়ন করে-২০১১ সালে পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ২০১৪ সালে সবুজ অর্থায়নের ন্যূনতম লক্ষ্য, ২০১৬ সালে জলবায়ু তহবিল, ২০২৩ সালে সাসটেইনেবল ফিন্যান্স নীতি এবং রিপোর্টিং ফরম্যাট চালুর মধ্য দিয়ে এ খাতকে আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলে। 
এদিকে দেশে টেকসই ও সবুজ খাতে অর্থায়ন বাড়লেও দিন দিন অবনতি হচ্ছে বায়ুর মান। বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) দিয়ে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়মিত বায়ু পরিস্থিতি তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ-এয়ার। তাদের তালিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই দূষণের প্রধান উৎস। বেশি মাত্রার দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদ্রোগ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বৈশ্বিক মানদ- অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে তা সহনীয়। ১০১-১৫০ এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ।
বায়ু দূষণের মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০৭ মাসের তথ্য প্রতিদিন প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালে শুধু ঢাকাতেই ৬ দিন ছিল ‘চরম ঝুঁকিপূর্ণ’, ৯৩ দিন ছিল ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’, ৭০ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’, ১৩৩ দিন ছিল ‘সতর্কতামূলক’ এবং ৪৯ দিন ছিল ‘মাঝারি মানের’ বায়ু। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মাত্র ১১ দিন ঢাকায় বাতাসের মান ‘ভালো’ ছিল। বছরের বাকি ৪ দিনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে দ্বিতীয় বায়ুদূষণ। এবং বাংলাদেশেই মৃত্যুর শীর্ষ ১০টি কারণের মধ্যে চারটি সরাসরি বায়ুদূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত: স্ট্রোক, নি¤œ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ও ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ। সম্প্রতি, সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যে সূক্ষ্মকণা বায়ুদূষণের প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বায়ুমান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুর মানদ- অর্জন করতে পারলে বাঁচানো সম্ভব হতো ৮১ হাজারের বেশি প্রাণ।
পরিবেশে অর্থায়ন বৃদ্ধি পেলেও আমাদের জীবনমানের কেন উন্নয়ন হচ্ছে না এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ অভি হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমি দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নের কাজ করি ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। দেশের পরিবেশের উন্নয়ন না হলে এই শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ কিভাবে বাঁচবে এটি আমার প্রশ্ন। শ্রমজীবী মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ওপরই কিন্তু দেশের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে।

তাদের জীবন বাঁচাতে আমরা কি ভূমিকা রাখছি তা বিভিন্ন কারখানায় গেলেই দেখা যায়। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা পরিবেশ বান্ধব নয়। যে কারণে অনেকেই নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। বিদেশীদের পরামর্শে অনেকেই কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরিত করেছে। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। বিজিএমইএ ২০২৪ সালের তথ্যমতে পরিবেশসম্মত সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন লিড কারখানার সংখ্যা মোট ২৩২টি। এতেই বোঝা যাচ্ছে যারা আমাদের দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের গুরুত্ব কত। তাই দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে পরিবেশের উন্নতি অপরিহার্য।      
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন,  বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই খাতে অর্থায়নের যে বিষয়টি বলেছে সেটা প্রথমদিকে অনেকগুলো ব্যাংক খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি এবং প্রচারও করেনি। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে শুরুর দিকে এই মেসেজ ছিল না। এখন ধীরে ধীরে বিষয়টি জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু এখনো আশানুরূপ দৃশ্যমান তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে এর ফলাফল আমরা দেখতে পাব, বলেন তিনি।

×