
চীনে আম রপ্তানির নতুন গন্তব্য বানাতে চায় বাংলাদেশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আম উৎপাদনে শীর্ষ দশে থাকলেও রপ্তানিতে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এর প্রধান কারণ আকাশপথে পণ্য পরিবহনের অস্বাভাবিক উচ্চ ব্যয় যা প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই চড়া ব্যয়ই ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলো থেকে ছিটকে দিচ্ছে। তবে সম্প্রতি আম রপ্তানি নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা দেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুণগত মান ঠিক রেখে আম উৎপাদন করতে পারলে কম পরিবহন ব্যয়ের সুবাদে বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার হয়ে উঠতে পারে চীন। রপ্তানিকারকরা জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি ফল পাঠাতে ইউরোপে ৩৫০-৩৮০ টাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ২০০-২২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়।
অন্যদিকে চীনে ফল পাঠাতে ভাড়া দিতে হয় আরও কম, কেজিতে ৭০-৮৫ টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান মনে করেন, আম রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ ‘প্রস্তুত’। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আম অন্যান্য দেশের তুলনায় গুণগত মানে ও স্বাদে ভালো। চীনের বাজারে এটা আমাদের এগিয়ে রাখবে।’
আরিফুর আরও বলেন, চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে আমের জন্য স্পেশাল কার্গো দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আশা করছি চীনে আম রপ্তানি নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করবে।
চীনের প্রতিনিধি দল কয়েক দফায় আমাদের দেশে এসেছে। তারা অনেক ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। এর সঙ্গে তারা কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলেছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি চীনে আম রপ্তানি নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করবে, বলেন তিনি।
কমছে আম রপ্তানি ॥ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩২১ টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ১০০ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছরই রপ্তানি কমছে।
বাংলাদেশ থেকে গত বছর ২১টি দেশে আম রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইতালি ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ রয়েছে। যদিও এর আগের অর্থবছরে ৩৬টি দেশে আম রপ্তানি হয়।
এনএইচবি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ও আম রপ্তানিকারক নাজমুল হোসেন ভুঁইয়া ১৯৯১ সাল থেকে আম রপ্তানি করছেন। গত বছর তিনি সুইডেন ও ইউরোপে আম পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছর প্যাকেজিং ও বিমান ভাড়া মিলে কেজিতে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। গতবার অস্বাভাবিক ভাড়ার কারণে রপ্তানিকারক ও যারা কিনেছিলেন, সবাই লোকসান দিয়েছেন।
নাজমুল বলেন, আম রপ্তানি নিয়ে আমাদের কোনো সমন্বিত কৌশল নেই। প্যাকিং হাউস করা হয়েছে শ্যামপুরে, পণ্য পাঠাতে হয় বিমানবন্দর থেকে। অথচ দুটি একই জায়গায় হওয়া প্রয়োজন ছিল। এতে খরচ কমত। আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে। আমাদের প্রণোদনা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে। আম রপ্তানিকারক ও গ্লোবাল ট্রেড লিঙ্কের স্বত্বাধিকারী রাজিয়া সুলতানা বলেন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো আম রপ্তানিতে আলাদা কার্গো ফ্লাইট ব্যবহার করে, অথচ বাংলাদেশ নির্ভর করে যাত্রীবাহী বিমানের ওপর। ‘ফলে ইউরোপে প্রতি কেজিতে আমাদের প্রায় ১.৫০ ডলার পরিবহন খরচ বেশি পড়ে। জিএসপি থেকে কিছুটা সুবিধা পেলেও আমাদের স্থানীয় আমের দাম তুলনামূলক বেশি। স্বাদে হয়তো আমরা এগিয়ে, কিন্তু গুণমানের ধারাবাহিকতায় ওরা আমাদের থেকে অনেকটা সুশৃঙ্খল। এখানেই আমরা পিছিয়ে আছি।’
চীনে নতুন আশা ॥ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরে আম রপ্তানি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে ঢাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে চীনও। রপ্তানিকারক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীন বছরে প্রায় ৪ লাখ টন আম আমদানি করে। মূলত থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন থেকে বেশি আম আমদানি করে চীন। তারা বলছেন, চীনে আম রপ্তানি করলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের তুলনায় খরচ কম পড়বে। তবে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আম রপ্তানিতে টিকে থাকতে পারবে কি না সেটা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। ২০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘চীনের মানুষ বাংলাদেশী আম পছন্দ করে’ বলে বৃহৎ পরিসরে আম রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। চীন বছরে প্রায় ৪ লাখ টন আম আমদানি করে। মূলত থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন থেকে বেশি আম আমদানি করে দেশটি। রপ্তানিকারক ও কর্মকর্তারা মনে করেন, গুণগত মান বজায় রাখতে পারলে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
নাজমুল ভুঁইয়া বলেন, ‘চীনে নতুন বাজার তৈরি হয়েছে, এটা নিয়ে আমি আশাবাদী। তবে টিকে থাকতে হলে আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। কারণ আমরা যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব, তারা আমাদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, চীন থেকে যেসব কার্গো বিমান পণ্য নিয়ে আসে, সেগুলো অনেক সময় খালি ফেরত যায়। এ কারণে চীনে রপ্তানিতে বিমান ভাড়া কম পড়বে। ‘এসব রিটার্ন ফ্লাইট পুরোটা ব্লক করা গেলে খরচ আরও কমে আসবে। হয়তো কেজিতে ৫০-৬০ টাকায় নেমে আসবে,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে চীন-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ প্ল্যাটফর্মের মহাসচিব অ্যালেক্স ওয়াং বাংলাদেশী আমের প্রতি চীনের আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ম্যাঙ্গো হারভেস্টিংয়ের সময় চীনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল বাগান ও প্যাকেজিং কার্যক্রম পরিদর্শন করবে। ইতোমধ্যে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।’
কমপ্লায়েন্স চ্যালেঞ্জ ॥ শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং গ্লোবাল.এ.পি. প্রশিক্ষক অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমসের গাইডলাইন অনুযায়ী আম রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে ৩০টি শর্ত পূরণ করতে হবে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশের আমে চীনের জন্য ২১টি কোয়ারেন্টিন পেস্ট শনাক্ত করা হয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে আমকে এসব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ‘পরিবহন-পূর্ব পরিদর্শনে প্রতি ব্যাচের ২ শতাংশ বা ৬০০টি আম যেটি বেশি হয় টেস্ট করতে হবে, এবং এর মধ্যে সন্দেহজনক ৬০টি আম কেটে পরীক্ষা করতে হবে। কোনো কোয়ারেন্টিন পেস্ট পাওয়া গেলে পুরো ব্যাচ বাতিল করা হবে। অধ্যাপক ফারুক বলেন, শুধু চীনের ক্ষেত্রে নয়, বরং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্যই গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস (গ্যাপ) কমপ্লায়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘গ্যাপ অনুসরণ করে রপ্তানির জন্য আম উৎপাদন করলে বা গ্যাপ সার্টিফিকেট থাকলে চীনের শর্ত মানা কঠিন হবে না।’ তিনি আরও বলেন, কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাড়তি সুবিধা দেয়। যেমন, থাইল্যান্ডের সঙ্গে চীনের ডুরিয়ান চুক্তি কিংবা আমের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের চুক্তি বাংলাদেশের জন্য মডেল হতে পারে। ‘চীনের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি করলে বাজারে প্রবেশ অনেকটাই সহজ হবে।’