
তীব্র তাপ প্রবাহের কবলে পড়েছে চা শিল্পাঞ্চল। তাপ প্রবাহে পুড়ছে চা গাছ, বাড়ছে রোগব্যাধি এমনি এক অবস্থা বিরাজ করছে চা শিল্পাঞ্চল খ্যাত সিলেট ও চট্টগ্রামের চা বাগানগুলোতে। ফলে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করেছেন চা উৎপাদকরা। চা বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সময়মতো বৃষ্টি না হলে ৭৫-৮০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত অনাবৃষ্টির সঙ্গে তীব্র দাবদাহে এমন অবস্থা। চা বাগানের জন্য যেমন ভারী বর্ষণ দরকার, তা এখনো হয়নি। সেচের পানি বেশি দিতে হচ্ছে বাগানগুলোতে। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আছেন তারা।
জানা যায়, দেশের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ক্ষুদ্রায়তনের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং পঞ্চগড় জেলা মিলে ৫৯ হাজার ১৮ হেক্টর জমিতে ১৬৯টি বাগানে চা উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কেবল মৌলভীবাজার জেলায় চা বাগানের সংখ্যা ৯০ এবং চা চাষের ভূমির পরিমাণ ৩৩ হাজার ১৬০ হেক্টর, যা জেলার মোট আয়তনের ৫৫ দশমিক ১৯ শতাংশ বলে জানা গেছে।
২০২৩ সালে ১৮৪ বছরের চা শিল্পে উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সালে ১৬৮টি চা-বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে শ্রমিক অসন্তোষ, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বিরূপ আবহাওয়া ও কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়াসহ নানা কারণে চায়ের উৎপাদন কমেছে।
পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বাগানের চারা গাছ মরে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। তাপে ঝলসে যাচ্ছে গাছের কচি পাতা। বিশাল সবুজের সমারোহ এখন কালচে লাল। চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমে নতুন পাতা আর কুঁড়ি না আসায় চা শ্রমিকরাও নির্ধারিত পরিমাণ চা পাতা সংগ্রহ করতে পারছেন না। এতে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন মৌসুমের শুরুতেই চা শিল্প প্রতিকূলতার মুখে পড়ায় কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এ অবস্থায় চায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে বিকল্প ইরিগেশন দিয়ে চা গাছকে প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টা করছেন চা বাগান কর্তৃপক্ষ। আলাপকালে চা শ্রমিকরা জানান, দুটি পাতা একটি কুঁড়িতে বৃষ্টির পরিবর্তে কৃত্রিম পানি সরবরাহের যে উৎসগুলো ব্যবহার হয় সেই লেক, পাহাড়ি ছড়াগুলোতেও নেমে গেছে পানির স্তর। তাপমাত্রার কারণে পোকামাকড় বেড়েছে। নতুন পাতা না আসায় অনেক কষ্ট করে বাগানে ঘুরে ঘুরে চা পাতা উত্তোলন করছেন তারা। ফলে মৌসুমের শুরুতে অর্ধেকের কম উৎপাদন হচ্ছে চা বাগানে। সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের ভুড়ভুড়িয়া চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক সারথী দেশওয়ারার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, বৃষ্টি না থাকার কারণে এই সময়ে সারা দিনে মাত্র ১০-২০ কেজি পর্যন্ত চা পাতা তুলতে পারছি। অথচ বৃষ্টি থাকলে আমরা এ সময়ে সারা দিনে ৩০-৪০ কেজি পাতা তুলতে পেরেছি। এতে তাদের দৈনিক ১৭০ টাকা হাজিরার (বেতন) জন্য যে ২৪ কেজি পাতা বাধ্যতামূলক তুলতে হয় তাও পূরণ হচ্ছে না।
চা শ্রমিক নেতা দীপংকর ঘোষ বলেছেন, খরায় বেশি পাতা তোলা যাচ্ছে না। শ্রমিকরা আগে যে পরিমাণ পাতা তুলতেন, এখন তার অর্ধেক পাতা তুলেছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ায় চা উৎপাদনে দুর্দিন চলছে। চা বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সময়মতো বৃষ্টি না হলে ৭৫-৮০ শতাংশ উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত অনাবৃষ্টির সঙ্গে তীব্র দাবদাহে এমন অবস্থা। চা বাগানের জন্য যেমন ভারী বর্ষণ দরকার, তা এখনো হয়নি। সেচের পানি বেশি দিতে হচ্ছে বাগানগুলোতে। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আছেন তারা।
বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেছেন, বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন কোনো উৎপাদন নেই বললেই চলে। তবে দু-একটি বাগানে পাতা চয়ন শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালি চা-বাগানের মালিক শিল্পপতি নাদের খান বলেছেন, বাগান জ্বলে যাচ্ছে। চা-শিল্পকে রক্ষায় শতভাগ ইরিগ্রেশনের বিকল্প নেই। এটি শতভাগ করতে পারলে উৎপাদন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। অন্যথায় চা-বাগান রক্ষা করা যাবে না। যদিও শতভাগ ইরিগ্রেশন অনেক ব্যয়বহুল।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেছেন, এই সময়ে চা অঞ্চলে ১৫-২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গত বছর মার্চে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। অথচ চলতি বছর মার্চে এসে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ মাসে এই অঞ্চলে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। জেলার সব চা বাগান খরার কবলে পড়েছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, চায়ের জন্য ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উত্তম। তবে সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি পর্যন্ত চা গাছ তাপ সহ্য করতে পারে। এর উপরে গেলেই খরায় পড়বে চা। চা পাতায় দেখা দিবে বাঞ্জি দশা। তবে চা বাগানে প্রতি ২০ ফিট অন্তর অন্তর সেড টি থাকলে তা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি পর্যন্ত সহনীয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, জেলার কিছু বাগানে চলতি মৌসুমে চা পাতা উত্তোলন শুরু হলেও টানা দাবদাহে প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন চা বাগানে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া ও তাপমাত্রা বেশি থাকায় চা গাছ খাদ্য তৈরি করতে পারছে না। এ কারণে চায়ের কুঁড়ি বের হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জনে চা বাগানে সমন্বিত পদ্ধতি মেনে চলা, চা গাছের গোড়ায় কচুরিপানা-লতাপাতা দেওয়া, প্রতিটি বাগানেই জলাধার তৈরি করা এবং সেচ পদ্ধতি চালু রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
প্যানেল