ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

ব্যাংক খাতে প্রধান চ্যালেঞ্জ

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:২৩, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

ব্যাংক খাতে প্রধান চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে ব্যাংক খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশের সার্বিক হালনাগাদ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ডিসেম্বর শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশ। জুন থেকে ডিসেম্বর এ ছয় মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, গত সরকারের সময়ে ব্যাংক দখল করে নজিরবিহীন লুটপাট করা হয়েছে। লুটপাটের টাকার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে ওইসব ঋণ এখন আদায় হচ্ছে না। আদায় না হওয়ার কারণে ব্যাংক সেগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের এ বৃদ্ধিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফ উদ্বেগজনক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যা এখন অন্যতম একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যেসব ব্যাংকে বেশি জালজালিয়াতি হয়েছে, ওইসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি শেষে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়ে অতিরিক্ত তরল সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকায়, যা সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছিল। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে ব্যাংক খাতে সব ধরনের আমানত ও ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। ঋণের সুদের হার বাড়ায় এবং সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে একদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। অন্যদিকে আমানতের সুদের হার বাড়ায় গ্রাহকরা ব্যাংকে সঞ্চয় করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জালজালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা কিছুটা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও তারল্যের জোগান বাড়ানো হয়েছে। এসব মিলে ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট ধীরে ধীরে কমে আসছে। প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার জন্য উচ্চ খাদ্যমূল্য, পণ্যের সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং অভ্যন্তরীণ অসম্পূর্ণ বাজার কাঠামোকে দায়ী করা হয়েছে। এসব সমস্যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের সার্বিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো সামনে রেখে মাঝারি মাত্রার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে পণ্যমূল্যের স্তরে স্থিতিশীলতা আনয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ও প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করছে। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্যও কাজ করছে। ফলে আগামী জুনের মধ্যে এ হার ৮ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত, সম্ভাবনা ও সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যব্যবস্থা দেশের অগ্রাধিকার খাতগুলোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি, রপ্তানিমুখী শিল্প, আমদানি বিকল্প শিল্প এবং কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাত। এসব খাতের বিকাশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ঋণখেলাপিদের জন্য আরও বড় ছাড় :
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও বড় ছাড় দিয়েছে। নতুন নির্দেশনায় এক্সিট সুবিধার শর্ত শিথিল করা হয়েছে, যাতে ঋণখেলাপিরা আগের চেয়ে কম ডাউন পেমেন্ট দিয়েই এ সুবিধা নিতে পারেন। সার্কুলারে বলা হয়েছে, এখন থেকে বিদ্যমান ঋণের ন্যূনতম ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদ পরিশোধ করলেই এক্সিট সুবিধার জন্য আবেদন করা যাবে, যা আগে ছিল ১০ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের ক্ষমতা বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকার পরিবর্তে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের এক্সিট সুবিধা অনুমোদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণ যদি নির্ধারিত কিস্তি অনুযায়ী পরিশোধ না হয় এবং তা খেলাপিতে পরিণত হয়, তাহলে কোনো অবস্থাতেই তা পুনঃতফশিলীকরণ বা পুনর্গঠন করা যাবে না। ব্যর্থ হলে ঋণ আদায়ের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতার আবেদন পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে বলে সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমাধান কোন পথে :
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ঋণখেলাপি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই সমালোচিত একটি বিষয়। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ছিল সবচেয়ে ভুক্তভোগী। সুশাসন ও শৃঙ্খলার অভাব এতটাই যে স্বাধীনতার পর বিগত ৫৪ বছরে এ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত এত বেশি সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়নি। নানা রকম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ঋণ জালিয়াতি, অবৈধ অর্থ পাচার থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারে কারসাজিসহ অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই চলেছে দুর্বৃত্তপনা। তারল্য সংকটে পড়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত থেকে শুরু করে আধাসরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এখন খেলাপি ঋণ আদায়ে যেসব বিষয় সুবিবেচনায় আনার প্রয়োজন রয়েছে তা হলো : প্রথমত, ঋণ বিতরণ ও আদায়ে সমতা বিধান করা। ঋণ বিতরণ যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে হয়, তাহলে আদয়ে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ব্যাংকার কাস্টমারের নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যারা অসাধুতাকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত করে তারা উভয়ই সমান দোষী। এ ব্যাপারে প্রথমে ব্যাংকারদের সতর্ক হতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে গ্রাহকদেরও এই পথ অনুসরণ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, দেশের বেসরকারি ও সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণত আর্থিক বাজারের অংশ হিসেবে স্বল্প মেয়াদে গৃহীতাদের ঋণের চাহিদা পূরণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এই ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে চার পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে যার বেশির ভাগ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মনীতি ভঙ্গ করে ঋণ দেওয়া এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার মতো একটি যাতনাকে বয়ে বেড়াচ্ছে যার ফলাফল তারল্য সংকট, মুনাফার ঘাটতি ও ইমেজ সংকট। তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে বৃহদাকার ঋণগুলোর স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেক অলাভজনক খাতেও ঋণ বিনিয়োগ হচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক লোন মঞ্জুর করা হয় যার বেশির ভাগ অনুৎপাদশীল খাতে চলে যায়, যার পরিণতি হয় খেলাপি ঋণ। এখন গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করলেও অন্তত ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাধর্র্মী আর্থিক খাতটিকে রাজনীতিমুক্ত রাখা যায় না কেন? এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তা, প্রশাসনিক সমর্থন ইত্যাদি তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য খুবই জরুরি। সর্বশেষ বলা যায় সরকার যদি সচেষ্ট হয় তবে সমাজিকভাবে এই সকল খেলাপি ঋণের মোকাবিলা করাও সম্ভব আবার প্রশাসনিকভাবেও সম্ভব। এখন কোনটি ভালো হবে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে। তবে সমস্যার আবশ্যিক শান্তিুপূর্ণ সমাধান হোক ব্যাংকিং শিল্পের স্বার্থে।

প্যানেল

×