ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

তিন মাসে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

উচ্চ খেলাপির কারণে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে

নাজমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১১ এপ্রিল ২০২৫

উচ্চ খেলাপির কারণে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে

.

ব্যাংক খাতের দুর্বলতার একমাত্র কারণ খেলাপি ঋণ। আর এ কারণে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এভাবে প্রভিশন বাড়তে থাকলে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।  
দেশের ব্যাংকগুলো ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রভিশন তথা সঞ্চিত রাখে। তবে ঋণ জালিয়াতি এবং অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, একই হারে পরিচালন মুনাফা না বাড়ায় পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক। এই তালিকায় কিছু সবল হিসেবে পরিচিত ব্যাংকের নামও এসেছে। প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকগুলোতে দুর্বলতার হাওয়া বইছে।  
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি না রাখার ফলে দেশের ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৫৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের ১৩ টি ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের পাঁচটি ও বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে, নি¤œমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে  ১৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বা ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে নয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, এছাড়াও জনতা ব্যাংকের ২৭ হাজার কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের আট হাজার ৮০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের সাত হাজার কোটি ও বেসিক ব্যাংক পাঁচ হাজার ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
তথ্য বলছে, ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫২ কোটি টাকা বা ৬৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে কমার্স ব্যাংকের ৫৩৩ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ১৭৫ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের, আইএফআইসি ব্যাংকের সাত হাজার ৮০০ কোটি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ১৩ হাজার ১০০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮ হাজার ৭০০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার ৬০০ ও স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ৩০৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংক দুর্বল হলেও  কয়েকটি ব্যাংক সবল হিসেবেও পরিচিত।
অন্যদিকে একই সময়ে প্রভিশন উদ্বৃত্ত রয়েছে বিদেশী ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর। বিদেশী ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল দুই হাজার ২২৫ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাংকগুলো আলোচ্য এ সময়ের মধ্যে প্রভিশন রেখেছে দুই হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশী ব্যাংকগুলোর ৪৬৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। এছাড়াও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার কথা ছিল দুই হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকগুলো রেখেছিল তিন হাজার ৮৪ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে প্রভিশন ঘাটতি হবে। কারণ, দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এরপরও সম্প্রতি খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। তাই পাল্লা দিয়ে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। যেখানে শতভাগ প্রভিশন রাখা দরকার। এখানে একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। এভাবে প্রভিশন বাড়তে থাকলে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। প্রভিশন ঘাটতি কমাতে হলে আগে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাইবাছাই করে দিতে হবে, যাতে টাকাগুলো আবার ফেরত আসে।
এ বিষয়ে অর্থনীতি গবেষক ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম. হেলাল আহম্মেদ জনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রভিশন হলো নিরাপত্তা সঞ্চিতি যা খেলাপি ঋণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। যদি কোনো ব্যাংক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি সংরক্ষণ করতে না পাওে, তাহলে তাদের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে বলে মনে করি।’  
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ পরিণত হয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২০ দশমিক ২ শতাংশ। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে।

×