ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল ইস্যু

সক্ষমতা বাড়িয়ে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে চায় বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১০ এপ্রিল ২০২৫

সক্ষমতা বাড়িয়ে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে চায় বাংলাদেশ

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন

ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করছে বাংলাদেশ। বরং নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে বাংলাদেশ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে বুধবার বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সেখানেও ব্যবসায়ীরা সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তারা বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হলেও, নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে না বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। বৃহস্পতিবারও দেখা গেছে, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে প্রভাব পড়েনি বাংলাবান্ধায়।

অন্য দিনের মতো এই দিনও এ শুল্ক স্টেশন দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর বুধবার সন্ধ্যায় ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের গেট থেকে চারটি পণ্যবোঝাই বাংলাদেশী ট্রাক ফেরত এসেছে। এই ট্রাকগুলোর পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় ভারতের বন্দর দিয়ে ইউরোপীয় একটি  দেশে যাওয়ার কথা ছিল। পরে পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো ঢাকায় চলে আসে। 
বৃহস্পতিবার এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ইস্যুটি ব্যবসায়ী মহলে আলোচনার বিষয় ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, ভারত হঠাৎ করে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করলেও এটি বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। তিনি বলেন, ‘এ সংকট কাটাতে আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘এমনকি গত (বুধবার) আমরা বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মিটিংয়ে ক্রেতারাও উপস্থিত ছিলেন। আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এই সংকট সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমরা নিশ্চিত করছি যে, কোনো সক্ষমতার অভাবে আমাদের প্রতিযোগিতা কমবে না। বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।

একই সঙ্গে আমরা সংযোগ উন্নত করতে কাজ করছি যাতে কোনো বিঘœ না ঘটে।’ এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এর মধ্যে কিছু অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, কিছু বাড়তি খরচের বিষয় রয়েছে। আমরা এসব ক্ষেত্রেও কাজ করছি। আমরা আশা করছি, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।’ বাংলাদেশ ভারতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট সুবিধা বাতিলের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে পারে কি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর এমন বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা আমার বিচারাধীন নয়। আমার উদ্বেগ হচ্ছে, সক্ষমতা উন্নয়ন।’
এ বিষয়ে ভারতকে কোনো চিঠি পাঠানো হবে জানতে চাওয়া হলে শেখ বশির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা চিঠি পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা করছি না।’
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) ২০২০ সালের ২৯ জুন একটি আদেশ জারি করে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের একটি শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছিল। গত ৮ এপ্রিল, সিবিআইসি সেই আদেশটি বাতিল করেছে।

এই বিষয়টি বুধবার ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যবসায়ী মহলে তোলপাড় শুরু হয়। ওই রাতেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হলেও, নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠাতে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ২০২০ সালে বর্ধিত করা হয়। এর ফলে গত পাঁচ বছরে ভারতের বিমানবন্দরগুলোতে ‘উল্লেখযোগ্য জট’ দেখা দেয়।”
এতে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের পণ্য আটকে থাকছে, বিলম্ব হচ্ছে এবং সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। জয়সওয়াল বলেন, ‘এ কারণেই ভারতের মধ্য দিয়ে বিমানবন্দর ও বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এতে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
এদিকে, এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের জেরে বুধবার সন্ধ্যায় ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের গেট থেকে চারটি পণ্যবোঝাই বাংলাদেশী ট্রাক ফেরত আসে। পরে পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো ঢাকায় চলে আসে।
বেনাপোল সংবাদদাতা জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হওয়ায় যেসব পণ্যবোঝাই ট্রাক এরই মধ্যে ভারতের ভূখ-ে আছে, সেগুলোকে দ্রুত ভারত ত্যাগ করতে হবে। আর এ আদেশের আগে যেসব পণ্য অ্যান্ট্রি হয়ে আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই।
ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলছেন, স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে। এ চিঠির আলোকে ট্রানজিট সুবিধার পণ্য বেনাপোল বন্দর থেকে পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলছেন, ভারত সরকার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করেছে। সে কারণে বেনাপোল বন্দর দিয়ে চারটি রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশের জন্য গেলে তা ফেরত পাঠায়। ট্রাকগুলো ঢাকার রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার অ্যান্ড সি লিমিটেডের ছিল।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদারও জানান, ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় পেট্রাপোল কাস্টমস তৃতীয় দেশের কোনো পণ্যে কার্পাস ইস্যু করেনি। ফলে বুধবার তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানির জন্য যাওয়া চার ট্রাক পণ্য তারা রিসিভ করেনি।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারতের ভূমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে কম খরচে ও কম সময়ে বাণিজ্য করার সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সুবিধা বাতিল করায় কয়েকটি দেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন রপ্তানিকারকরা।
বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া ট্রাক, কাভার্ডভ্যান খাতেও ছিল একটি বড় আয়ের উৎস। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রপ্তানি পণ্য বোঝাই শত শত ট্রাক যেত বেনাপোল বন্দরে। সেখান থেকে পেট্রাপোল বন্দরে পণ্য আনলোড করে চলে আসত। এতে তারা নির্দিষ্ট একটি ভাড়া পেত। সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। এমনিতেই বাংলাদেশী পর্যটকের অভাবে মহাসংকটে রয়েছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ফলে কেবল পেট্রাপোল স্থলবন্দরেই ৪০ শতাংশ আর্থিক ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
পেট্রাপোল স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, বাংলাদেশ থেকে আসা কন্টেনারগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক এবং অন্যান্য পণ্য থাকত। এসব পণ্য ভারত হয়ে যেত তৃতীয় দেশে। পণ্যগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রথমে পেট্রাপোল স্থলবন্দরে যেত। এরপর সেগুলো কাস্টমস সিল হয়ে জাতীয় সড়ক দিয়ে যেত দিল্লি। জাহাজেও যেত কিছু পণ্য। সেখান থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানি হতো।
তিনি জানান, পেট্রাপোলে প্রতিদিন যদি ২০০ গাড়ি আসত, তার ৪০ শতাংশ থাকত এই ধরনের পণ্য, অর্থাৎ ট্রান্সশিপমেন্টের গাড়ি। পণ্যগুলো বাংলাদেশ থেকে আসত, তা আমাদের না এবং আমাদের দেশে বিক্রিও হয় না। সেগুলো বিক্রি হয় বিদেশে। তারা আমাদের বন্দরটি ব্যবহার করত মাত্র। কিন্তু যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা ৪০ শতাংশ কাজ হারাল। ট্রান্সশিপমেন্টে যেসব ট্রাক বা ট্রেলার যুক্ত ছিল, তারা কাজ হারাল। লজিস্টিক কোম্পানিগুলো যারা বন্দর পর্যন্ত এই পণ্যগুলো পৌঁছে দিত, তারাও কাজ হারাল।
প্রভাব পড়েনি বাংলাবান্ধায় ॥  
ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায়। অন্য দিনের মতো বৃহস্পতিবারও এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। বিকেলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৃহস্পতিবার নেপাল ও ভুটান থেকে অন্যদিনের মতোই এসেছে বোল্ডার পাথর, সুগার মোলাসিস, অর্গানিক রংসহ অন্যান্য পণ্য। 
৪৩টি পণ্যবাহী ট্রাকে এক হাজার ২৪০ টন পণ্য আমদানি করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল, আলু, টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্যের ২২টি ট্রাকে ৪৮৩ টন পণ্য যায় নেপালে।
স্থলবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে নেপালে নিয়মিত আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। ৯ এপ্রিল ৩১৫ মেট্রিক টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হয়। গত দুই মাসে থিংকস টু সাপ্লাই, হুসেন এন্টারপ্রাইজ, স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ ও ক্রসেস অ্যাগ্রো নামে চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এই স্থলবন্দর দিয়ে কয়েক দফায় তিন হাজার ১৫০ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করে নেপালে।
স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের সঙ্গনিরোধ পরিদর্শক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, রপ্তানিকারক চারটি প্রতিষ্ঠান রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আলুগুলো সংগ্রহ করে নেপালে পাঠায়। সবশেষ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হয়েছে নেপালে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের স্থলবন্দরে আপাতত আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি তেমন কোনো নির্দেশনা আসেনি। আজও আমাদের এই বন্দর দিয়ে বিভিন্ন পণ্য ভারত ও নেপালের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। অন্য দিনের মতো বৃহস্পতিবারও আমরা কাজ করেছি।’
বন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি রপ্তানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের জানাতে চাই, আমাদের এখানে কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিকভাবেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে।

×