ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক ইকবাল আহমেদকে নিয়ে নানা প্রশ্ন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার 

প্রকাশিত: ২১:২৩, ৯ এপ্রিল ২০২৫

এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক ইকবাল আহমেদকে নিয়ে নানা প্রশ্ন

ছবি সংগৃহীত

দুর্নীতির দায়ে ২০১৫ সালে লন্ডনের আদালত জরিমানা করার পর ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার থেকে আজীবন বহিস্কার হয়েছিলেন সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ। হাসিনা সরকারের সময় সকল প্রকার সুযোগ সুবিধে নেওয়া ফ্যাসিবাদের দোসর সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ ওবিই এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক (চেয়ারম্যান) হওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।

গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক আদেশে তাকে নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক করা হয়। এতে ব্যাংকের প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছেন গ্রাহকরা।

বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটের সহযোগী, হিমায়িত মাছ ব্যবসার আড়ালে অবৈধ চোরাচালান চালিয়ে রাতারাতি দেশ-বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া, যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা লুটপাটের টাকা হুন্ডিযোগে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন, এভাবে যিনি শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে আওয়ামী লীগের ১৪ বছর লুটপাট করেছেন তাকে এনআরবি ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসানো হলো কিভাবে?

বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতো জুলাই বিপ্লবে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে ফের এই ইকবালদের মাধ্যমে লুটপাট হোক তা চাইছেন না ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ইকবালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু ছবিও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে গত ১২ মার্চ এনআরবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। ৭ সদস্যের এ পরিচালনা পর্ষদে ইকবালকে পরিচালক এবং অন্যদের স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়। অর্থাৎ ইকবাল এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন ফ্যাসিবাদের সমর্থক ইকবাল এনআরবি ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।

উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদসহ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তারা দ্রুত এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। মোটা দাগে এনআরবি ব্যাংকে বাঁচাতে ইকবালকে অপসারণের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য তাদের। প্রাপ্য তথ্য বলছে, ইকবালের বিরুদ্ধে ২ শত হাজার পাউন্ড লোপাটের অভিযোগ এনে লন্ডনের আদালতে ২০১৫ সালে মামলা করেন ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ। আদালত ইকবাল কে ৫ লক্ষ পাউন্ড জরিমানা করে। অর্থাৎ ইকবাল দুর্নীতিবাজ এবং ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বারের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রমাণ হয় কোর্টের রায়ে।

ইকবালের উত্থান সম্পর্কে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিনি বিগত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন। হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। তখন তার ফেসবুকে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তোলা অসংখ্য ছবি শেয়ার করা হয়েছিল যা জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতার পালাবদলের পর মুছে ফেলা হয়। জুলাই বিপ্লবের পর ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে বিপ্লবী সাজতে নানা কৌশল চালাচ্ছেন তিনি।

ইকবালের চোরাচালান সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রপ্তানিকারক বলেন, সীমার্ক গ্রুপের গুদামে মাছের বদলে জমা হয় ইলেকট্রনিক্স, অবৈধ ড্রাগ ও সোনার বার। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এসব চোরাচালান ধামাচাপা দিতেন তিনি। লন্ডনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ করে লন্ডন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইকবালের দুই ডজন বাড়ি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে অত্যাধুনিক প্রপার্টি যা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসব পাচারের টাকায় লন্ডনে গড়ে তোলা বিভিন্ন কোম্পানি ইকবালের ভাই ও ভাতিজাসহ পরিবারের সদস্যরা পরিচালনা করছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইবকো হোল্ডিংস লিমিটেড, ভারমিলিওন গ্রুপ লিমিটেড, ফ্লাইং ইউনিকর্ন লিমিটেড, মাই ইনভেসমেন্ট হোল্ডিংস লিমিটেড, ওপেন হাও হোল্ডিংস লিমিটেড, ইবকো লিমিটেড, সীমার্ক পিএলসিসহ মোট ১৪ টি কোম্পানি। সূত্র বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইকবালের নাম জড়িয়ে ছিল শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গহর রিজভীর সঙ্গে। তার অর্থ পাচারের সিন্ডিকেটের অন্যতম ছিলেন এই ইকবাল।

আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, সুইস ব্যাংকে গওহর রিজভীর নামে জমা হওয়া ১২ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৪০ শতাংশ ইকবালের মাধ্যমে পাচার করা হয়। তাদের তদন্তে দেখা গেছে, ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন রেমিট্যান্স হস্তান্তরের ভুয়া ডকুমেন্টেশন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর এড়িয়ে অপকর্ম চালায় ইকবাল।

এছাড়া এস কে সুর চৌধুরীর ব্যাংকিংখাতে অর্থ লুটপাটের যে নেটওয়ার্ক ছিল তাতেও ইকবাল ছিলেন একজন শক্তিশালী সদস্য। সেই সময়ও একটি ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ লুটপাট করেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ থাকায় এসব অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সময়ে ইকবালের কোন বিচার হয়নি।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন ব্যক্তির মাধ্যমে এত বড় আকারের দুর্নীতি সম্ভব হয় শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সরকারের উচিত এই নেটওয়ার্কের মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনা। এ বিষয়ে ইকবাল আহমেদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

আশিক

×