ছবি: প্রতীকী
চুক্তিভিত্তিক প্রান্তিক ব্রয়লার খামারে মুরগির উৎপাদন ব্যয় কম হয়। ফলে খামারি এবং ভোক্তা উভয়ে লাভবান হন। বাড়তি উৎপাদন হয়, উৎপাদন খরচ কমে যায়। ফলে খামারি বেশি মুনাফা পান এবং ভোক্তাও কম দামে কিনতে পারেন। দেশের পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক উদ্যোক্তা পোল্ট্রি কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মুরগির খামার পরিচালনা করছেন। এতে করে তারা কম খরচে বেশি মুরগি উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছেন। পাশাপাশি তারা কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে খামার রক্ষা করতে পারছেন। সেই সাথে ব্রয়লার মুরগির বাজার দরের অপ্রত্যাশিত পতনের ঝুঁকিরও দায়মুক্ত থাকতে পারছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ খাতের নানা প্রকাশনা থেকে দেখা যায় যে, উন্নত দেশ—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, চীন, থাইল্যান্ড, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ার পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো চুক্তিবদ্ধ ক্ষুদ্র খামারিদের মাধ্যমে মুরগি উৎপাদন করে। সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোল্ট্রি খামারিরাও সে পথে হাঁটতে শুরু করেছে। ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয় ডিলারদের মাধ্যমে কেনা একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা লালন-পালনের পরিবর্তে খামারিরা সরাসরি বিভিন্ন কোম্পানির সাথে মুরগি উৎপাদনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
জানা যায়, পোল্ট্রি কোম্পানিগুলো প্রথমত: ব্রয়লার খামারের শেডসহ মুরগি লালন-পালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ (যেমন—ফিডার, ড্রিঙ্কার, ব্রুডার) সরবরাহের উপযুক্ত খামারিদের তালিকাভুক্ত করে। এরপর চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিগুলো খামারিদের মুরগির বাচ্চা, ফিড এবং ওষুধ সরবরাহ করে।
এর বাস্তবতা জানতে দেশের অন্যতম প্রধান পোল্ট্রি কোম্পানি কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “আমরা আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ খামারিদের বিনামূল্যে বাচ্চা, ফিড ও ওষুধ সরবরাহ করি। কোম্পানির এলাকা ভিত্তিক কর্মকর্তারা চুক্তিভিত্তিক প্রতিটি খামারের রোগবালাই প্রতিরোধে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা দেন। এরপর নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে উৎপাদন সক্ষমতার ভিত্তিতে খামারিদের গ্রোয়িং চার্জ দেওয়া হয়। সাধারণের চেয়ে বেশি ওজনের মুরগি উৎপাদনকারী খামারিকে পুরস্কারস্বরূপ বেশি গ্রোয়িং চার্জ দেওয়া হয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে কাজী জাহিন বলেন, “চুক্তিভিত্তিক ব্রয়লার খামার পরিচালনায় খামারিদের যেহেতু কোনো চলতি মূলধন লাগে না এবং রোগের কারণে কোনো মুরগি মারা গেলে তার দায়ভার কোম্পানির থাকে, সেহেতু খামারি কোনো পুঁজি হারান না। সে কারণে ক্রমেই এ ব্যবস্থায় খামারিরা আকৃষ্ট হয়ে উঠছেন।”
পক্ষান্তরে মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত ডিলার নির্ভর খামারিদের সাথে যোগাযোগে জানা যায়, তারা কখনও কিছু মুনাফা করলেও তাদের লোকসানের পাল্লা ভারী। এ ধরনের অনেক খামারি লোকসানের মুখে পুঁজি হারিয়ে ঋণের দায় নিয়ে খামার বন্ধ করতে বাধ্য হন। বিভিন্ন কারণে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। একইভাবে দামেও তারতম্য ঘটে।
রাজধানীর নিকটবর্তী জেলা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গলদা পাড়ার ব্রয়লার খামারি জহিরুল ইসলাম (৩৫) বেসরকারি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে নিজ বাড়ির আঙিনায় মুরগির খামার করেছেন। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞ এ খামারি জানান, “প্রথমে স্থানীয় ডিলারের সাথে খামার করে দুই বছরে ৮০ হাজার টাকা লোকসান গুনেছি। এরপর কাজী ফার্মসের সাথে বিনিয়োগ ও ঝুঁকিমুক্ত খামার করছি। প্রতি ব্যাচে (৩৫ দিনের মেয়াদে) এক হাজার মুরগিতে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় পাচ্ছি।”
প্রসঙ্গত জহিরুল জানান, “গত মধ্য মার্চেও প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি করেছি ১৩৬ টাকা দরে। যা গড় উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। এতে আশপাশের ব্যক্তি পর্যায়ের খামারিরা বড় অংকের লোকসান গুনলেও চুক্তি অনুযায়ী কাজী ফার্মস আমাকে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দিয়েছে।”
প্রায় অভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়েছেন গলদা পাড়ার অপর চুক্তিভিত্তিক খামারি মোঃ সুমন (৩২)। প্রায় এক যুগের অভিজ্ঞ এই খামারি জানান, “নিকটস্থ কাশেমপুর বাজারের ডিলারের সাথে খামার করে আড়াই লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছি। এক ব্যাচে ১০ হাজার টাকা লাভ হলে পরের ব্যাচে ৫০ হাজার লোকসান গুনেছি। এভাবে বছর দুয়েকে পুঁজি হারিয়ে দেনা নিয়ে খামার ছেড়ে স্থানীয় গার্মেন্টসে চাকরি করেছি। পরে চুক্তিভিত্তিক খামারে নিশ্চিত লাভের খবরে কাজী ফার্মসের সাথে খামার করে হাজার মুরগিতে ব্যাচান্তে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় পাচ্ছি। এখন বাচ্চা, ফিড, ওষুধ, চিকিৎসা—এমনকি মুরগি বিক্রির চিন্তাও আমার নেই, সব কিছুই কোম্পানি করে। বিক্রির কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যাংক একাউন্টে লাভের টাকা জমা হয়ে যায়।”
ময়মনসিংহ জেলার ডুবাইলের বজলুল করিম (৬২) মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দফায় প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে এক দশক ধরে মুরগির খামার করছেন। থানা সংযোগ সড়কের পাশে উন্মুক্ত এলাকার শেডে হাজার মুরগির এই ব্রয়লার খামারি জানান, “প্রথম দিকে ডিলারের সাথে লেয়ারের খামারে সুফল মেলেনি। পরে নিজে ব্রয়লার করেও সুবিধা হয়নি। ফলে গত দুই বছর কাজী কোম্পানির সাথে ব্রয়লার খামারে ভাগ্য খুলেছে। এখন প্রতি ব্যাচে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পাচ্ছি।”
এ প্রসঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনাগ্রহী পোল্ট্রি খামার বিশেষজ্ঞ মোঃ সুমন আলী জানান, “অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ স্বতন্ত্র পোল্ট্রি খামারি স্থানীয় ডিলারদের নিয়ন্ত্রণে খামার করে অধিকাংশ সময় লোকসান গুনছেন। তাদের উৎপাদন খরচ বেশি, মুরগি মৃত্যুর হারও বেশি। বেশিরভাগ সময় উপযুক্ত ওজন ও মেয়াদ শেষের আগে ডিলারদের চাপে মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হন। কখনও কখনও বাজারে বাড়তি চাহিদার কারণে ভালো দাম পেলেও খামারির হাতে তেমনটা পৌঁছে না।”
কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসানের মতে, প্রান্তিক খামারিরা চুক্তিভিত্তিক ব্রয়লার খামার করে আশাতীত উপকৃত হচ্ছেন। তিনি বলেন, “ব্যক্তি কেন্দ্রিক স্বাধীন খামারিরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নন, মূলত তারা সব সময় ডিলারদের কাছে ঋণী থাকেন। বাকিতে বাচ্চা ও ফিড নিয়ে করা খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে কিংবা ব্রয়লারের বাজার দরে পতন ঘটলে খামারিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েন। তাদের বিনিয়োগের সবটাই লোকসানে পরিণত হয়।”
“তবে চুক্তিবদ্ধ খামারিদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। রোগাক্রমণে খামারের কিছু মুরগি মারা গেলেও যে পরিমাণ মুরগি বেঁচে থাকে তার ওপরে খামারি গ্রোয়িং চার্জ পেয়ে থাকেন। আবার ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কম হলে সে ক্ষতিও পুরোটা কোম্পানি (কাজী ফার্মস) বহন করে, খামারি নয়। ফলে আমাদের খামারিরা সন্তুষ্ট। যদি কোনো কারণে সন্তুষ্ট না হন, তাহলে পরবর্তী ব্যাচ থেকে তারা স্বাধীন হতে পারেন,”— উল্লেখ করেন জাহিন হাসান।
এম.কে.
