
- চুক্তি হবে নাসার সঙ্গে
- রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠক হবে বিদেশী উদ্যোক্তাদের
- প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে বড় বিনিয়োগকারীদের
চারদিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ শুরু হচ্ছে সোমবার (৭ এপ্রিল) থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন , জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৪০টি দেশ থেকে ৭’শ বিনিয়োগকারীরা এতে অংশ নেবেন। সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিনিময় হবে। একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে জার্মানী, কোরিয়া ও চীনের মতো বড় বিনিয়োগকারীদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। রবিবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিনিয়োগ সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটা জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, এবারের সামিটে ওয়ানওয়ে বক্তৃতা বা ডায়াসে দাড়িয়ে কথা বলার সুযোগ কম। ৪ দিনের সামিটের প্রথম দুই দিনে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখবেন, যেখানে তারা কারখানা স্থাপন করতে পারবেন। সামিটের প্রথম দিনে ৬০ জনের বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীকে নিয়ে একটি বিশেষ বিমান চট্টগ্রাম যাবে। যেসব উদ্যোক্তা মনে করছেন তাদের সেখানে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে হবে, তাদের জায়গা জমি লাগবে। তাদের জন্য আমরা কী ধরনের সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করতে পারি তা তারা সরেজমিনে দেখবেন। সেখানে তারা কোরিয়ান ইপিজেড ও মিরসরাইয়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন পরিদর্শন শেষে রাতে ফিরে আসবেন। একইসঙ্গে ওইদিন দ্বিতীয় ট্র্যাকে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে প্ল্যানারি সেশন ও স্টার্টাপ কানেক্ট হবে। সেখানে যেসব আরলি সেটজ স্টার্টআপ এবং ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী আসছেন তাদের মধ্যে ম্যাচ মেকিং ইভেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও প্যানেল হবে। সারাদিন স্টার্টআপ ইভেন্টকে ফোকাস করা হবে।
পরেরদিন (৮ এপ্রিল) যাবেন নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার। এসব স্থানে গিয়ে তারা ওখানে যারা বর্তমানে কারখানা স্থাপন করেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাদের অভিজ্ঞতা শুনবেন। ব্রেকআউট সেশনে এফডিআই’র সম্ভাবনা যে ৫টি খাতে সবচেয়ে বেশি যেমন, নবায়নযোগ্য জ্বালানী, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ঔষধ শিল্প, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং টেক্সটাইল নিয়ে ম্যাচমেকিং সেশনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা, সাক্ষাৎ করা, যেন ভবিষ্যতে এখানে যৌথ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা যেন নীতিগত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে সেটা করতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে বিশ্বব্যাংক ও আইএলও’র সঙ্গে কিছু অ্যানগেজমেন্ট আছে। তাদের এফডিআই রিলেটেড কিছু ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ৯ এপ্রিল বুধবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়া সারাদিনই একাধিক (তিন-চারটা) প্যারালাল অনুষ্ঠান চলবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি পাঁচজন বিনিয়োগকারিকে পুরস্কার দেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত থাকবেন। একইসঙ্গে কয়েকজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বক্তব্য দেবেন। সেখান থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব আর কী করলে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য বেটার ডেস্টিনেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইয়ুথ এন্টারপ্রেনারশিপ মেলার আয়োজন থাকবে। উপদেষ্টা সেখানে আরলি স্টেজ কোম্পানির সঙ্গে কথা বলবেন। দ্বিতীয় ধাপে রিনিউয়েবল এনার্জি নিয়ে কথা হবে। বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। তারা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এছাড়া মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার সঙ্গেও চুক্তি হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদিও তার বাসভবনে ফেরত যাবেন, কিন্তু যারা একেবারেই খুব সিনিয়র তাদের সঙ্গে তার বাসভবনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন। আপনারা জানেন আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরই বিনিয়োগের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। এজন্য তিনি নিজেই চেয়েছেন যারা বড় উদ্যোক্তা আসবেন তাদের সঙ্গে যেন তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলাদা করতে বসতে পারেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারেন। যেমন জার্মান একটি বড় ডেলিগেশন আসবে। তাদের সঙ্গে, কোরিয়ানদের সঙ্গে এবং চায়নিজদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বসবেন। কারণ প্রতিটি গ্রুপের আবার ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা আছে বাংলাদেশে।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সমস্যা হবে কিনা, জানতে চাইলে বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের যে ক্রাইসিস, সেটা ফিল্টার করলে দেখা যাবে দেশের টপ কিছু ব্যাংক লাস্ট কোয়ার্টারে রেকর্ড প্রফিট ঘোষণা করেছে। প্রথমবারের মতো দেশের ৪-৫টি ব্যাংক রেকর্ড মুনাফা করেছে। এমন না যে, পুরো ব্যাংক খাত লোকসানে আছে। যারা ভালো ব্যাংক তারা অনেক মুনাফা করছে, যারা দুর্বল ব্যাংক তারা অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ফলে দুইয়ের মাঝে একটি গ্যাপ তৈরী হয়েছে। বিনিয়োগকারী যদি বাংলাদেশে আসেন এবং তিনি যদি উচ্চমানের বিনিয়োগকারী হন তাহলে অর্থায়নের অভাব হবে এটা একদমই মনে করি না। কারণ শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকগুলো শীর্ষ গ্রহিতাদের অর্থায়ন করতে প্রস্তুত থাকে। তারল্যের ক্ষেত্রে যারা ভালো মানের বিনিয়োগকারী, তাদের কখনো অর্থায়নের ঝামেলা বা তারল্য সংকটে পড়তে হয় না। আমার মনে হয় না দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এমন পর্যায়ে যে, বিদেশের একজন ভালোমানের বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে এসে লোন না পাওয়ার কারণে একটা ফ্যাক্টরি সেটআপ করতে পারবেন না। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ব্রিটিশ-অ্যামেরিকান ট্যোকাবো, ইউনিলভার, গ্রামীনফোন, লাফার্জ হোলসিম ইত্যাদির মতো যারা বিদেশী বিনিয়োগকারী এসেছেন তারা গ্লোবালি যে হারে মুনাফা করেন আর বাংলাদেশে যেভাবে মুনাফা করেন, দুইয়ের পার্থক্য অনেক। বাংলাদেশে রিস্ক প্রোফাইল অনেক বেশি, একইসঙ্গে রিটার্ন প্রোফাইলও অনেক বেশি।
আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, সম্মেলনে ৩টি রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহনে আহ্বান জানানো হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি। তারা প্রত্যেকেই নিশ্চিত করেছেন তাদের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার বিষয়ে। অনুষ্ঠানের একটি ব্রেকআউট সেশনে তাদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে। যতটুক জানতে পেরেছে তারা একটি পরিকল্পনা নিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হবেন যে, তারা ক্ষমতায় আসলে বা রাজনৈতিক সরকারের অংশ হলে বিনিয়োগ ব্যবস্থা নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কি হবে। এখন যে সব সংস্কার হচ্ছে সেগুলোকে তারা কতটা সমর্থন করেন এবং পরবর্তীতে তারা আর কি কি সংস্কার করবেন এবং বিনিয়োগকে কতটা প্রাধান্য দেন সে সব বিষয়ে তাদের মতামত জানাবেন। কারণ বিনিয়োগকারীরা পলিটিক্যাল কন্টিনিউইটি নিয়ে অনেকটা উদ্বিগ্ন থাকেন অনেক সময়। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার ধরুন ২০টি সংস্কার করলো কিন্তু পরবর্তী সরকার যদি সেসব থেকে ইউটার্ন করে তাহলে তো বিনিয়োগ ব্যবস্থার উন্নতি হলো না। তাই আমরা দেখাতে চাই যে, রাজনৈতিক দলগুলোও আমাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে, তাদের সম্মতি আছে এবং তারাও মনে করেন সবার জন্যই বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারাও আমাদের সেই সাপোর্টটা দিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও দিবেন। এক্ষেত্রে আমরা তাদের থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি।
এসময় ট্রাম্পের শুল্ক নীতি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা প্রশ্ন করলে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বিষয়ে আশিক মাহমুদ বলেন, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত একটি দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত। একটি বিষয়ের কারণ এটা রাতারাতি উল্টো ঘুরে যাবে এমন না। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকেই আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম যে, ট্রেড ইমব্যালেন্সকে কিভাবে রিব্যালেন্স করতে পারি। যেহেতু আমাদের এবিষয়ে সূচনা করা আছে, তাই আশা করি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা একটি সুন্দর সমাধানের দিকে যাবো। ইতোমধ্যে আমরা কালেক্টিভ ওয়েতে সবার সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাই এ নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই।
বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠানটি ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারিত হবে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ইন্টারভিউ নিতে মিডিয়া কর্নার থাকবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম, ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি অপূর্ব জাহাঙ্গীর।
জাহিদুল ইসলাম /রাজু