
১১ প্রভাবশালী পরিবার বেশি অর্থ পাচারে জড়িত
বাংলাদেশ থেকে ঠিক কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব না দিতে পারলেও অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ২৫ বিলিয়ন ডলার ফেরতের জোরালো প্রচেষ্টা শুরু করেছে।
এ সরকারের দাবি আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার করেছে। তবে বেশিরভাগ অর্থ পাচার করেছে ১১টি প্রভাবশালী পরিবার। এদেরকে টার্গেট করে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শুক্রবার ‘বাংলাদেশ আপ এগেইন্টস টাইম টু ফাইন্ড স্টোলেন বিলিয়নস : সেন্ট্রাল ব্যাংক গভর্নর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন আল জাজিরা। সংবাদমাধ্যমটির ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটকে (আই-ইউনিট) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
আল-জাজিরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, প্রভাবশালী এ ১১ পরিবারের বিরুদ্ধে গত এক দশক ধরে ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে কোটি কোটি ডলার পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যাদের সম্পদের সন্ধানে ১১টি বিশেষজ্ঞ দলও গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশ্নবিদ্ধ এ সম্পদের পরিমাণ আঁতকে ওঠার মতো।
১১টি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারের বিরুদ্ধেই ১৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে একটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ আমানতই তুলে নিয়ে গেছে তারা। এতে ব্যাংকটি প্রায় ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে দাবি করা হয় প্রতিবেদনে।
বিদেশী ওই গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূলত হাসিনার আমলে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অভিজাতদের বিদেশে পাচার করা বিপুল সম্পদ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছি। এ পরিবারগুলোর অনেকেরই বহু সম্পদ রয়েছে লন্ডনে।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার তীব্র বিক্ষোভের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন আহসান এইচ মনসুর। তিনি আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ।
পাচারকৃত অর্থ দ্রুত উদ্ধার করা নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বেশ উদ্বিগ্ন। কেননা, দ্রুত সন্ধান না পেলে বেশিরভাগ অর্থ মিলিয়ে যেতে পারে।
আল-জাজিরাকে এইচ মনসুর বলেছেন, আমরা জানি সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সম্পদের পরিমাণ কমে যেতে পারে। আহসান মনসুরের সন্ধান কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ব্রিটেন। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া আনুমানিক ২৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ উদ্ধার এবং জব্দ করার জন্য ইতোমধ্যেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কমনওয়েলথ দপ্তর এবং লন্ডনের আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
অর্থ পাচার বিষয়ক একটি বার্তা সকলকে দিতে চান এই গভর্নর। তিনি বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আমরা এই সচেতনতা তৈরি করতে চাই যে, বিশ্ব থেকে চুরি হওয়া সম্পদের প্রিয় হচ্ছে ব্রিটেন। আর বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি যেখান থেকে এখানে প্রচুর চুরি হওয়া সম্পদ এসেছে।
এর আগে আল-জাজিরার আই-ইউনিটের এক খবরে প্রকাশ করা হয়েছে যে, হাসিনার সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর একারই লন্ডন এবং দুবাইতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থের সম্পদ রয়েছে। আই-ইউনিটের ওই খবরটি গতবছর প্রকাশ করা হয়। ব্রিটেনে সাইফুজ্জামান এবং তার পরিবারের ৩৬০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।
এগুলোর বেশিরভাগই লন্ডনে। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যেই সাইফুজ্জামানের ৪০টি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে এবং তাকে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আর সাইফুজ্জামানের বিদেশে থাকা সম্পত্তি দ্রুত জব্দ করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেন সেগুলো বিক্রি করতে না পারে।
যদিও সাইফুজ্জামানের দাবি হচ্ছে আগের সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘ডাইনি-হান্ট’ শুরু করা হয়েছে। তার সম্পদ বৈধভাবে উপার্জন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন এসব সম্পদ জব্দ করার দিকে মনোনিবেশ করেছে তখন আহসান এইচ মনসুর চাচ্ছেন, ব্রিটেন এবং অন্যান্য জায়গায় এসব অভিজাত পরিবারের কোটি কোটি ডলার পাচারে সহায়তাকারী আইনজীবী, ব্যাংকার এবং এস্টেট এজেন্টদেরও তদন্তের আওতায় আনা হোক।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইন লঙ্ঘন করে অপরাধীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছে এমন এজেন্ট বা ব্যাংক অপারেটর সংখ্যা অনেক। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তার দাবি, পাচারকৃত অর্থের নিয়ন্ত্রণ পেতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কর্তৃপক্ষের কাজের মাত্রা এবং জটিলতা নিয়ে লড়াই করার কারণে অর্থ উদ্ধার কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতিতে আগাচ্ছে। তবে ব্রিটেন সরকার এক্ষেত্রে সহায়তা করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এসব অপরাধী চক্রের মূল হোতার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তাকারীদের সঙ্গে দর কষাকষি করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এমনকি হারিয়ে যাওয়া অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরিকল্পনাও রয়েছে।
এ নিয়ে একটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তনের পর পাচারকৃত কোটি কোটি ডলার উদ্ধারের কার্যক্রম পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) তহবিল স্থগিত করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে যে তদন্তকারী সংস্থা কাজ শুরু করার কথা ছিল তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের পূর্ণ শক্তিতে ঢাকায় থাকার কথা ছিল। তাদেরকে ইউএসএআইডির মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছে। তবে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আর আসতে পারেনি। যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর।