ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

মার্কিন অধ্যাপকের গবেষণা ॥ পর্যাপ্ত পরিকল্পনা, সমন্বয়ের ঘাটতি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সম্ভব হচ্ছে না

বছরে এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায় সম্ভব

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৩ মার্চ ২০২৫

বছরে এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায় সম্ভব

জাকাত একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক ব্যবস্থা

দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য জাকাত একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক ব্যবস্থা এবং তহবিল সংগ্রহের খাত। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকল্পনা, সমন্বয়ের ঘাটতি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। রাজস্ব আদায়ের মতো জাকাত আদায় করা গেলে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকা জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ না করায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করার পরও দরিদ্র মানুষের তা কাজে আসছে না।

ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও আমেরিকার নিউ অরলিয়েন্স বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবীর হাসান এক গবেষণায় এমন চিত্রই তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে জাকাত সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হলে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে।
দেশে সরকারি পর্যায়ে জাকাত সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় কার্যকরী প্রতিষ্ঠান নেই। এর বিপরীতে বেসরকারি পর্যায়ে দুই তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের অধীনে জাকাত ফান্ড বিভাগ রয়েছে। কিন্তু এই দেশে জাকাত প্রদানে সক্ষম কত মানুষ রয়েছে, কত অর্থ সামগ্রিকভাবে আদায় করা হয় এমন কোনো তথ্য জানা নেই প্রতিষ্ঠানটির। এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই সরকারি জাকাত ফান্ড বিভাগের। এ বিষয়ে জাকাত ফান্ডের কর্মকর্তারা বলেন, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকা ও গবেষণা না থাকার কারণে পর্যাপ্ত জাকাত আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না।
গত বছর ইসলামী ফাউন্ডেশনে জাকাত সংগ্রহের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ের সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে এ বছর দেশের ৬৪ জেলা থেকে ২০ কোটি টাকা জাকাত আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগের বছর যা ছিল মাত্র ১০ কোটি টাকা। জেলা পর্যায় থেকে যে অর্থের জাকাত আদায় করা হয় তার ৭০ ভাগ টাকা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাকাত হিসেবে প্রদান করা হয়। বাকিটা কেন্দ্রীয়ভাবে দরিদ্র মানুষের হাতে তুলে দেয় সরকারি জাকাত ফান্ড। 
সরকারিভাবে জাকাত ব্যবস্থাপনা খুব বেশি না আগালেও গত এক দশকে বেসরকারি পর্যায়ে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ বেড়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট, আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন ও চ্যারিটি প্লাটফর্ম। বেসরকারি পর্যায়ে ১২ বছর সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প ও জাকাতের তহবিল গঠন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত অবসরপ্রাপ্ত ১০ জন সচিব ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা। 
সিজেডএম-এর চেয়ারম্যান নিয়াজ রহিম বলেন, প্রতিবছর জাকাত ফেয়ারসহ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে নানা রকম কার্যক্রম নেওয়া হয়। জাকাতের অর্থ দিয়ে এক যুগে সাড়ে ৬ লাখ মানুষের খাবার, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। ৬ প্রকল্পের আওতায় এক লাখ মানুষকে স্বাবলম্বী করা হয়েছে। এ ছাড়াও তিন হাজার তরুণকে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ১৪ হাজার শিক্ষার্থীকে বছরে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মূলত জাকাত, সাদাকাহ, ওয়াক্ফ, অনুদান থেকে প্রতিষ্ঠানটি অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমাদের দেশে জাকাত হিসেবে মানুষের হাতে শাড়ি-লুঙ্গি দেওয়ার চল রয়েছে। কিন্তু জাকাতের টাকা গরিব মানুষের প্রাপ্য হক। শাড়ি লুঙ্গির বদলে যদি উপার্জনক্ষম কোনো উপকরণ উপকারভোগী ব্যক্তিকে দেওয়া হতো, তবে জাকাতের স্বার্থকতা থাকত। ইসলামী স্কলাররা বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত প্রদান করা অনেক ভালো। তবে ব্যক্তি পর্যায়েও জাকাত প্রদানের সুযোগ আছে।

তবে আমাদের দেশে জাকাত প্রদান করা হয় ভুল প্রক্রিয়ায়। জাকাত প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য এই অর্থের মাধ্যমে অন্যকে স্বাবলম্বী করা। যাতে আগামী ১০ বছর পর সেই ব্যক্তিও জাকাত দিতে উপযুক্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে গত ১০ বছর আগেও যেই ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়া হতো, এখনো তাকেই জাকাত দেওয়া হচ্ছে। এতে সামাজিকভাবে কোনো পরিবর্তন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে জাকাতের সম্ভাব্য অবদানের পরিমাণ সম্পর্কে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে জাকাত আদায়ের কোনো উদ্যোগ এখনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেয়নি। এ কারণেই জাকাতের প্রকৃত পরিমাণ অজানা।
২০২২ সালে বাংলাদেশে জাকাত সংগ্রহের সম্ভাব্যতা অনুমান করার একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় সরকারি অফিস, ওয়েবসাইট, বই এবং জার্নাল থেকে মাধ্যমিক ডেটা ব্যবহার করে বাংলাদেশে সম্ভাব্য জাকাত অনুমান করা হয়েছে। জাতীয় সম্ভাব্য জাকাত অনুমান করার প্রক্রিয়ায়, নয়টি উৎস বিবেচনা করা হয়েছে।

এরমধ্যে  ব্যাংক আমানত, শেয়ার এবং সিকিউরিটিজ, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পশুসম্পদ, মৎস্য, কৃষি-শস্য ও বনজ, শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্য পরিষেবা এবং খনি। এই খাতগুলো থেকে অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মূল্য বিভিন্ন উপায়ে পাওয়া যায়, অর্থাৎ নিসাবের বিভিন্ন হার। জাকাতের সম্ভাব্যতা গণনা করার জন্য নিসাব সমন্বয়ের অংশ হিসাবে যোগ্য খাতে জীবন-যাপনের ব্যয়ের সমন্বয় প্রয়োগ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায় বর্তমানে পরিষেবা খাতে জাকাত আদায়ের পরিমাণ অনেক বেশি। ২০০০-০১ সালে এই খাত থেকে যে অর্থ জাকাতের জন্য সংগ্রহ করা হতো, ২০১৮-১৯ সালে তা এগারো গুণ বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে ব্যাংক আমানত। ২০০১ সালে ব্যাংক আমানত যা ছিল ২০১৯ সালে তা ১৪ গুণ বেড়ে আড়াই হাজার মিলিয়ন ডলার হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে এই খাত-নির্দিষ্ট জাকাতের সম্ভাব্যতা অনুমান করে। সে অনুযায়ী গেল ২০ বছরে পরিষেবা খাতে জাকাতের সম্ভাবনা এগারো গুণ বেড়েছে। শেয়ার এবং বন্ডের ওপর জাকাত ছিল ২০০০-০১ সালে ১৮ মিলিয়ন, ২০১৮-২০১৯-এ প্রায় এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার তার বিশাল সম্পদ এবং জনবল দিয়ে জাকাত বিতরণ চ্যানেলকে প্রসারিত করতে পারে। জাকাত বরাদ্দ কিভাবে, কখন, কার কাছে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে একটি পৃথক আইন ও নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সময়মতো এবং সঠিকভাবে জাকাতের ওপর কর রেয়াত ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হলে জাকাতের প্রয়োজনভিত্তিক বরাদ্দ কার্যকর করা যাবে।

এ ছাড়াও জাকাত সংগ্রহের (বার্ষিক) এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য সংরক্ষণ প্রয়োজন। রাজস্ব বরাদ্দের মতো, সরকার সম্ভাব্য জাকাত আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেও এই জাকাত আদায় সম্ভব। এর জন্য একটি ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা পরিচালিত হওয়া উচিত। এই ধরনের ব্যবস্থা মানুষকে সহজে একটি মোবাইল অ্যাপে জাকাত গণনা করে তাৎক্ষণিকভাবে জাকাত জমা দিতে সক্ষম করবে।
সোনা ও রুপা ॥ সোনা ও রুপা অর্থনীতির পরিভাষায় অন্যতম মেরুদ-। সোনা ও রুপার জাকাত না দেওয়ার কারণে ইসলামে ভয়াবহ শাস্তির বিধানও রয়েছে। কারও কাছে অন্তত ৭.২৯ ভরি সোনা এক বছর যাবত থাকলে জাকাত দিতে হবে। এবং সেই ব্যক্তিকে আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হবে। ওই ব্যক্তির কাছে যে ক্যারেটের সোনা রয়েছে তার বাজার মূল্য জেনে আড়াই শতাংশ জাকাত প্রদান করতে হবে। বিভিন্ন ক্যারেটের সোনা থাকলে তার হিসাবও ভিন্নভাবেই করতে হবে।

একইভাবে কারও কাছে ৫১ ভরির বেশি রুপা থাকলে তার জন্যও জাকাত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সোনার মতো একইভাবে এক্ষেত্রে জাকাত দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে হীরা, মুক্তা, গোমেদ বা এমন মূল্যবান পাথরের জন্য জাকাত বাধ্যতামূলক নয়। তবে যদি এটি ব্যবসায়ী পণ্য হয় সেক্ষেত্রে জাকাত দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
নগদ অর্থের জাকাত ॥ ব্যাংক নোটকে নগদ অর্থ হিসেবে বিবেচনা করা করা হয়। সে অনুযায়ী যার যে পরিমাণ অর্থ আছে তাকে ৪০ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা দাঁড়ায় সে পরিমাণ অর্থ জাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির কাছে ৪ লাখ টাকা থাকলে তাকে ১০ হাজার টাকা জাকাত দিতে হবে। ঋণ দাতার জাকাতের জন্য জাকাত দেওয়ার বিধান রয়েছে।

কোনো ঋণদাতার অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক। তবে টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লে জাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমাণ সোনা, রুপা ও ব্যবসায়ী পণ্যের মালিক হন তবে তিনি তার সম্পদের জাকাত দেবে। ঋণের কারণে কখনোই জাকাত মওকুফ হবে না।
ব্যবসায়িক  বা শিল্প পণ্যের জাকাত ॥ ব্যবসা উদ্দেশে ক্রয় করা সব ধরনের পণ্যই ব্যবসায়িক সম্পদ হতে পারে। যেমন জায়গা, জমি, দালান-কোঠা। এসব সম্পদ একক বা একাধিক মালিকানার জন্যও জাকাত দেওয়া প্রযোজ্য। অন্যদিকে বিক্রির জন্য নার্সারির বীজ, খামারে ফুটানো মাছের রেণু, মুরগির বাচ্চা ইত্যাদিও ব্যবসা ও জাকাত দেওয়ার জন্য বিবেচ্য হবে। তবে বাকিতে কেনা মালামাল, অপরিশোধিত শ্রমিক পাওনা থাকলে জাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
কোম্পানি বা শেয়ার স্টকের জাকাত ॥ কোম্পানির জাকাতের জন্য ইসলামে পৃথক নীতিমালা আছে। এক্ষেত্রে কোম্পানির মোট অর্থের জাকাত কোম্পানির পক্ষ থেকে দিতে হবে। এতে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা সবার অংশ হারে জাকাত দেওয়া হবে। হিসাবের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পদ ছাড়া সব সম্পদ জাকাতের আওতায় আসবে। যৌথ মূলধনীর ক্ষেত্রে কোম্পানি নিজেই সব শেয়ারের অনুকূল জাকাত প্রদান করবে অথবা শেয়ার হোল্ডাররা পৃথকভাবে জাকাত দিতে পারবেন।
জমিজমা ও ইজারা সম্পত্তির জন্য জাকাত ॥ বর্তমান সময়ে জমির দাম বহু অংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমি বলতে শুধু জমি নয় এর ওপর অবস্থান করা সম্পত্তিকেও বোঝানো হয়। যেসব ভূমির ওপর মানুষ তার পরিবার  নিয়ে বসবাস করছে সেই জমির জন্য জাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ব্যবসায়িক কারণে জমি প্রস্তুত করা হলে তার জাকাত দিতে হবে।
গবাদি পশু ও শস্যের জাকাত ॥  পশুর ক্ষেত্রে জাকাতের জন্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা অন্তত ৪০টি, গরু ও মহিষ ৩০টি, উট ৫টি হলে জাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর নিচে হলে জাকাত দিতে হবে না। তবে এক্ষেত্রে চন্দ্র বর্ষ অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। এক্ষেত্রে ৫টি উট কারও থাকলে তাকে একটি ছাগল বা সমমূল্যের জাকাত প্রদান করতে হবে। অন্যদিকে শস্য বা ফসলের জন্যও জাকাত ফরজ।

উৎপাদিত শস্যের দশ ভাগের একভাগ কোনো কোনো জমির ক্ষেত্রে ২০ ভাগের এক ভাগ জাকাত হিসেবে হকদারকে দেওয়াকে উশর বলে। ইসলামী পরিভাষায় যাকে ফসলের জাকাত বলা হয়। এক্ষেত্রে সেচবিহীন জাকাতের হার ১০ শতাংশ ও সেচযুক্ত ফসলের জাকাতের হার ৫ শতাংশ। 
ইসলামী অর্থনীতিবিদরা জানান, জাকাতের বরাদ্দ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে অর্থনীতির উৎপাদন স্তরে প্রভাব পড়ে। এতে দারিদ্র্যের হার কমে। তবে বাংলাদেশে সরকারিভাবে জাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুছে ফেলা সম্ভব  হচ্ছে না।

×