
নোডস ডিজিটাল লিমিটেড, একটি জলবায়ু সহনশীল কৃষিপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, সম্প্রতি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৪টি স্টার্টআপের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক সোলার এক্স চ্যালেঞ্জ ২০২৪’ পুরস্কার অর্জন করেছে। এই প্রতিযোগিতাটি ‘আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্স’ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা ১০০ এর অধিক সদস্য রাষ্ট্রের একটি বৈশ্বিক আন্তঃসরকারি সংস্থা। এটি সৌরশক্তি প্রসারে কাজ করে। নোডস ডিজিটালকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাদের সৌর, ইন্টারনেট অব থিংস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত ‘ই-সেচ’ সমাধানের জন্য, যা ধান চাষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পানির ব্যবহার কমাতে সক্ষম এবং কৃষি খাতের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে।
২০২৩ সাল থেকে নোডস ডিজিটাল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘ই-সেচ’ প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করছে, যেখানে বোরো ধানের চাষ হয়। সম্প্রতি নোডস ডিজিটাল ‘অ্যালুনাইটেড টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস’-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ অর্থায়িত প্রকল্পে প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। ‘ড্যাসকো ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক বাস্তবায়িত এই প্রকল্পটি ৩০ হেক্টরেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং ১০০০ এর বেশি কৃষকের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি বাংলাদেশের স্থানীয় উদ্ভাবনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো ব্যয়বহুল আমদানিকৃত প্রযুক্তির পরিবর্তে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ এবং সমগ্র বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত স্থায়িত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অত্যধিক শক্তি, পানির ব্যবহার এবং উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের কারণে টেকসই কৃষি অর্জন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে চাষকৃত জমির ৭৭ শতাংশ জুড়ে শস্য উৎপাদন হয়, যার মধ্যে বোরো ধান ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করে। ধান চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়, যা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার লিটার। দেশব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে এবং বিশেষত রাজশাহী বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলে এই সমস্যা আরও প্রকট। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ডিজেল এবং ১০ শতাংশ বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে সেচ পরিচালিত হয়, যার ফলে প্রতিবছর ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন লিটার ডিজেল খরচ হয় এবং ৪ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়। এই ডিজেলচালিত সেচ ব্যবস্থা বাংলাদেশের কৃষি খাত থেকে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলছে।
ই-সেচ: প্রযুক্তি ও পরিবেশগত প্রভাব
এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায়, নোডস ডিজিটাল সৌরশক্তিচালিত এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (৪ওজ) প্রযুক্তিনির্ভর ‘বিকল্প সিক্ত ও শুষ্ক’ সেচ ব্যবস্থা ‘ই-সেচ’ উদ্ভাবন করেছে। এই প্রযুক্তি ধানক্ষেতের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাউড সার্ভারে তথ্য প্রেরণ করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলের মাধ্যমে ফসলের পানির চাহিদা এবং গাছের চাপের মাত্রার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এর ফলে কৃষকেরা বাস্তব সময়ের তথ্য ব্যবহার করে ৭ থেকে ১১ ভাগ বেশি ফলন অর্জন করতে পারেন।
এই ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আল্ট্রাসোনিক সেন্সরের ব্যবহার, যা পানির স্তরের সঠিক পরিমাপ প্রদান করে এবং পানির অপচয় হ্রাস করতে সহায়তা করে। টেকসই উপাদানে নির্মিত হওয়ায় এটি কঠোর পরিবেশেও দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। ‘ই-সেচ’ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পানির ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব, পাশাপাশি মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করে পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করা যায়।
সৌরশক্তির ভূমিকা এবং ভাড়া ভিত্তিক মডেল
নোডস ডিজিটালের ‘ই-সেচ’ পদ্ধতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারের লক্ষ্যে সরকার কাজ করলেও উচ্চ প্রাথমিক খরচ, সীমিত আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব এবং বাজার সংযোগের সমস্যা রয়েছে। ‘ই-সেচ’ প্রযুক্তির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দেশের কৃষি খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এই লক্ষ্যে নোডস ডিজিটাল একটি ভাড়াভিত্তিক পরিষেবা মডেল অনুসন্ধান করছে, যেখানে হার্ডওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ এবং সফটওয়্যার পরিষেবা মৌসুমভিত্তিক ভাড়ায় কৃষকদের প্রদান করা হবে। এটি কৃষকদের ওপর প্রাথমিক বিনিয়োগের বোঝা কমাবে এবং প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশের কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য নোডস ডিজিটাল লিমিটেডকে সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ‘২৮তম বিশ্ব বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৪’-এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন সমাদ্দার এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতারা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।