ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১

উৎসবমুখী অর্থনীতি

জলি রহমান

প্রকাশিত: ১৮:০১, ২২ মার্চ ২০২৫

উৎসবমুখী অর্থনীতি

উৎসবমুখর পোশাক খাত
ঈদের মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে পোশাক ও ফ্যাশন খাত। শপিং মল, মার্কেট ও ফুটপাতজুড়ে থাকে  ক্রেতাদের ভিড়। ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস আগেই নতুন পণ্য সংগ্রহ করে বাজারে আনার প্রস্তুতি নেন। বিশেষ করে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড, বুটিক ও দর্জি শিল্পের ব্যবসায়ীদের জন্য এটি সবচেয়ে লাভজনক সময়। ঈদের বাজার শুধু পোশাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; জুতা, কসমেটিকস, গহনা, ইলেকট্রনিক পণ্য, গাড়ি, আসবাবপত্রসহ প্রায় সব ধরনের খাতেই বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মহামারির পর থেকে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসাও বেড়েছে। ফেসবুক ও ই-কমার্স সাইটগুলোর মাধ্যমে কেনাকাটার প্রবণতা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। অনেক ব্যবসায়ী ঈদের বিক্রির ওপর নির্ভর করে সারা বছরের বাজেট পরিকল্পনা করেন। ছোট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম, যা তাদের পুরো বছরের ব্যয়ের জোগান দিতে পারে।
উল্লেখ্য, গত বছর রোজার ঈদে পোশাক খাতে লেনদেন হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার, জুতা-কসমেটিকসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্যে ৭ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগে ১০ হাজার কোটি, যাকাত-ফিতরায় ৩৮ হাজার কোটি, সোনা-হীরায় ৫ হাজার কোটি, ভ্রমণে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিক্সে ৪ হাজার কোটি টাকাসহ ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।


বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ই-কমার্সের বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট ডটকমের তথ্য বলছে, ২০২৬ সালে দেশের ই-কমার্সের বাজার হবে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রায় ৫০ হাজারের  বেশি ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে, যা এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা নামে পরিচিত। এদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির মতো। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ই-কমার্স থেকে পণ্য কেনেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪ অনুসারে, দেশের ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮টি প্রতিষ্ঠান অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পণ্য ও সেবা দিয়ে থাকে।
ঈদে কর্মসংস্থান ও অস্থায়ী চাকরি
বাড়তি কাজের চাপ সামলাতে ঈদের সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন লোক নিয়োগ করেন। এ কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বিশেষ করে দর্জি ও পোশাকশিল্পের কারখানাগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয় অতিরিক্ত কর্মী। যেমন দোকান সহকারী, ডেলিভারি ম্যান, রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার এবং হকার। তবে যানজট, টিকিট কালোবাজারি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও সড়ক দুর্ঘটনাসহ এসব খাতে কিছু নেতিবাচক দিকও এ সময়ে পরিলক্ষিত হয়।
রেমিটেন্স ও অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য
ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা অনেক বেশি রেমিটেন্স পাঠান দেশে। বিশ্বব্যাপী কর্মরত বাংলাদেশীরা বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে পরিবার-পরিজনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দেশের আর্থিক প্রবাহ বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর রমজান মাস ও ঈদের আগে রেমিটেন্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই রেমিটেন্স গ্রামীণ অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করে। চলতি (মার্চ) মাসের ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার বেশি। এই ১৯ দিনের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে রেমিটেন্স এসেছে প্রায় ১২ কোটি ডলার বা এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মার্চে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।


গত বছরের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে প্রবাসী আয়ের গতি। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ (প্রায় ২৬৪ কোটি ডলার) রেমিটেন্স আসে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে ফেব্রুয়ারিতে (প্রায় ২৫৩ কোটি ডলার)।
ঈদ বোনাস ও এর প্রভাব
সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা ঈদের আগে বেতন ও বোনাস পান, যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের জন্য বোনাস সময়মতো দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায়। ব্যবসায়ীরা এই সময়টায় বর্ধিত বেতন-বোনাসের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও ঈদে বিক্রির মাধ্যমে তা পুষিয়ে নিতে সক্ষম হন। বোনাসের অর্থ সাধারণত বাজারে ফিরে আসে, কেননা বেশিরভাগ মানুষ তা ঈদের কেনাকাটা ও ভ্রমণের পেছনে ব্যয় করেন।
পরিবহন ও পর্যটন খাতের উত্থান
ঈদ মানেই দেশের লাখো মানুষের নাড়ির টানে গ্রামে ফেরা। ফলে পরিবহন খাতে এ সময়ে ব্যবসা থাকে রমরমা। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান টিকিটের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে যাতায়াত করেন, যা রেন্ট-এ-কার ব্যবসার জন্য একটি বড় সুযোগ।
এছাড়া ঈদের ছুটিতে মানুষ পরিবারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরতে যান। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, বান্দরবান, রাঙামাটি ও সিলেটের মতো স্থানগুলোতে পর্যটকের সংখ্যা যায় বেড়ে। ফলে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও স্থানীয় দোকানদারদের আয় বাড়ে।


রমজানের অর্ধেক যেতে না যেতেই চার লক্ষাধিক পর্যটক সক্ষমতার হোটেল মোটেলে ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। কক্সবাজারের পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, আগের বছরের চেয়ে এবার ঈদে পর্যটন বাণিজ্য ভালো হবে। পর্যটন খাতের সূত্রমতে, প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে থাকেন। এর সঙ্গে যুক্ত হন ৫ লাখের বেশি বিদেশী পর্যটক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০ লাখের বেশি মানুষের। প্রতি বছর এ খাত থেকে আসে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সারা বছরের চেয়ে দুই ঈদ ঘিরে পর্যটন ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকেন। এই মৌসুম ঘিরে অস্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হয় কয়েক হাজার মানুষের। দেশের জনপ্রিয় পর্যটনস্পটের তথ্য, সড়ক, রেল ও আকাশপথের যাত্রীদের চিত্র, ট্যুর অপারেটরদের তথ্যের ভিত্তিতে এবার পর্যটন খাতে বাণিজ্য ২ হাজার কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
বিনোদন খাত ও ঈদ অর্থনীতি
দেশীয় সিনেমা ব্যবসার জন্য ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বড় বাজেটের সিনেমাগুলো এই সময়েই মুক্তি পায়, কারণ প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের উপস্থিতি থাকে বেশি। এছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর সাবস্ক্রিপশনও বাড়ে। ঈদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক, সিরিজ ও সিনেমা মুক্তি পায়, যা বিজ্ঞাপন ও সাবস্ক্রিপশন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। পার্ক, চিড়িয়াখানা, মেলা ও অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্রেও দর্শকের ভিড় বাড়ে। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অফার ও ডিসকাউন্ট চালু করেন, যা অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করে।
জাকাত ও দান-সাদকা
ঈদ শুধু কেনাকাটা ও ভোগের নয়, এটি দান-সাদকারও সময়। মুসলমানরা জাকাত ও ফিতরা প্রদান করেন, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক উপকারী। বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা জাকাত হিসেবে বিতরণ করা হয়। এই অর্থ দরিদ্রদের পোশাক, খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। ব্যবসায়ীরাও ঈদ উপলক্ষে বড় আকারে দান করেন। যা দরিদ্র মানুষের কাছে সরাসরি অর্থ প্রবাহিত করে। তবে এই দানের অর্থ আরো সুসংগঠিত ভাবে দিলে দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা কমে যেত। যেমন গৃহপালিত পশু বা সেলাই মেশিন দানের মাধ্যমে অনেক দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করা সম্ভব।
ঈদ আনন্দের পাশাপাশি অর্থনীতির আকার বড় করে।  তবে ঈদের পর বাজারে প্রায়ই মন্দাভাব দেখা যায়। কেনাকাটার ধাক্কা সামলে মানুষ কিছুটা সঞ্চয়মুখী হয়, ফলে বিক্রয় কমে যায়। তবে এটি সাময়িক, কারণ অর্থনৈতিক প্রবাহ স্বাভাবিক হতে খুব বেশি সময় লাগে না।

×