ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

১৯ দিনে এলো সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার

ঈদের আগে প্রবাসী আয়ে জোয়ার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ২১ মার্চ ২০২৫

ঈদের আগে প্রবাসী আয়ে জোয়ার

বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা

পবিত্র রমজান মাস চলছে। আসছে খুশির ঈদ। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ছে বিভিন্ন কেনাকাটা। তাই পরিবার-পরিজনের বাড়তি খরচের কথা মাথায় রেখে বেশি বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি মার্চ মাসের প্রথম ১৯ দিনে ২২৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। দেশীয় মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার হিসাব (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) ধরে এই অঙ্ক ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের শেষে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় আসবে বলে আশা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মার্চ মাসের ১৯ দিনে গত বছরের একই সময়ে তুলনায় ৭৮ শতাংশ রেমিটেন্স বেড়েছে। গত বছর মার্চ মাসের প্রথম ১৯ দিনে ১২৬ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এ ছাড়া চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত দুই হাজার ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার এসেছে; যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে একই সময় রেমিটেন্স এসেছিল এক হাজার ৬৩৪ কোটি মার্কিন ডলার।
গেল ফেব্রুয়ারি মাসে বৈধ পথে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স এসেছে, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসেবে)। দৈনিক গড়ে রেমিটেন্স এসেছে ৯ কোটি ডলার বা এক হাজার ১১০ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিটেন্স এসেছে এবং আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার এবং নভেম্বর মাসে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অর্থাৎ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা ৭ মাস দুই বিলিয়নের বেশি রেমিটেন্স এসেছে বাংলাদেশে। 
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্যতম উপাদান হলো প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ও বিদেশী ঋণ। তবে এর মধ্যে প্রবাসী আয় ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশী মুদ্রা খরচ করতে হয় না, আবার কোনো দায়ও পরিশোধ করতে হয় না।

কিন্তু রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশী মুদ্রা খরচ করতে হয়। অন্যদিকে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশে রিজার্ভ বাড়ে। অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে, যা বছরের শেষ মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। এর ফলে ২০২৪ সালের সার্বিক পুরো বছরে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গেল বছরে বিপুল রেমিটেন্স এলেও এখনো বড় অঙ্ক অবৈধ পথে চলে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বৈদেশিক শ্রমবাজারে ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী যুক্ত হয়েছেন। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে পাঠানো জনশক্তির অঙ্ক ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার ৪৮৭ জন। এই বিপুল জনশক্তির অর্জিত আয় বৈধ পথে দেশ আনতে পারলে বাৎসরিক রেমিটেন্সের অঙ্ক ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত। 
রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে ২০২৪ সালে বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশে সাড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। শীর্ষে ছিল ভারত। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি ব্লগের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু। ভারত ২০২৪ সালে আনুমানিক ১২৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে।

যা যে কোনো দেশের এক বছরে পাওয়া সর্বোচ্চ রেমিটেন্স। এ ছাড়া গত বছর বৈশ্বিক রেমিটেন্সের মধ্যে ভারত একাই নিয়ে গেছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই অঙ্কও চলতি শতকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। গত বছর রেমিটেন্স অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেক্সিকো। দেশটির প্রবাসীরা দেশটিতে ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। তৃতীয় স্থানে থাকা চীনা প্রবাসীরা নিজ দেশে পাঠিয়েছেন ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চতুর্থ স্থানে থাকা দেশটি হলো ফিলিপাইন।

দেশটির প্রবাসীরা দেশটিতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। পঞ্চম স্থানে থাকা দেশটি হলো ফ্রান্স। দেশটির প্রবাসীরা গত বছর মোট ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। তালিকার ষষ্ঠ স্থানে আছে পাকিস্তান। গত বছরে দেশটি ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পেয়েছে। সপ্তম স্থানে থাকা বাংলাদেশ গত বছর রেমিটেন্স পেয়েছে ২৬ দশমিক ৬৮৯ বিলিয়ন ডলার । রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে থাকা দেশটির নাম মিসর।

দেশটির প্রবাসীরা গত বছর নিজ দেশে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন এবং নবম ও দশম অবস্থানে থাকা দুই দেশ যথাক্রমে গুয়াতেমালা ও জার্মানি। উভয় দেশের প্রবাসীরা নিজ নিজ দেশে সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স এসেছে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি ডলার, ২০২৩ সালে এসেছিল ২ হাজার ১৯২ কোটি ডলার, ২০২২ সালে আসে ২ হাজার ১২৯ কোটি, ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২০ সালে রেমিটেন্স আসে ২ হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে আসে এক হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৮ সালে  এসেছিল এক হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে এসেছিল এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

এর আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে এসেছে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক দশকে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। ২০১৪ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। সে হিসাবে ২০২৪ সালে বেশি এসেছে ১ হাজার ১৯৭ কোটি ডলার।

×