
.
হতাশা কাটিয়ে আমানতকারীরা ফের ব্যাংকে টাকা রাখতে শুরু করেছেন। ব্যাংক খাতে অনেকটাই স্বস্তি ফিরে আসছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে অনেকটাই বিপর্যয় নেমে আসে। দুর্বল হয়ে যায় অনেকগুলো ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংকে বেড়েছে আমানত। তবে ব্যাংকারদের মতে, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর এবং পূর্বের সঞ্চয়ের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে মোট আমানতের পরিমাণ বেশি দেখাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে মানুষের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশকিছু ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থার চিত্রও প্রকাশ পায়। তাতে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি পূর্বের চেয়ে উন্নতির দিকে।
পাশাপাশি ব্যাংকে আমানতের সুদহারও বেড়েছে। এ কারণে গ্রাহকরা আবার তাদের হাতে থাকা টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে আনছেন। এতে একদিকে বাড়ছে আমানত, অন্যদিকে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, দেশের মোট ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ৪৫ ব্যাংকের আমানত বেড়েছে। তবে আমানতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ ব্যাংকের।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল সিটিজেন ব্যাংকের ৩৮.৯৭ শতাংশ। এ ছাড়া সীমান্ত ব্যাংক ৩৮.৩৫ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ৩৩.৩৮ শতাংশ, মেঘনা ব্যাংক ২৮.৬১ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ২৭.৭৭ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ২৭.৪৭ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক ২৭.১৭ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংক ২২.৬৮ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ২১.৫৬ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ২০.৫৭ শতাংশ, শাহ্জালাল ইসলামী ১৫.২১ শতাংশ এবং ব্যাংক এশিয়ার ১৫.০৪ শতাংশ আমানত বেড়েছে। এমনকি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যাওয়া ইসলামী ব্যাংকেরও আমানত বেড়েছে চার শতাংশ। ব্যাংকটির আমানত বেড়ে এক লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে জমা রাখছে মানুষ। ব্যাংকগুলো এখন আর বিশেষ ধার না পাওয়ায় অনেক আমানতকারীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য দিনে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা উত্তোলনের সীমা করার কারণে এসব ব্যাংকের খারাপ অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। এ রকম অবস্থায় কোনো কোনো ব্যাংকের ভল্ট খালি হলেও অনেক ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই। সীমান্ত ব্যাংকে বেশি টাকা জমা পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিচ্ছে অনেক শাখা।
ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ ব্যাংক এখন আমানত সংগ্রহের জন্য ১০ শতাংশের কাছাকাছি সুদহার অফার করছে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক যদি নতুন করে কোনো ঋণ বিতরণ নাও করে তারপরও বছর শেষে আমানত প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। কারণ পূর্বের আমানতের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে মোট আমানত বাড়বে। ব্যাংকের ওপর আস্থা ফেরাতে কাজ করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় অফার।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে মিডল্যান্ড, মেঘনা, পদ্মা ব্যাংক, ইউনিয়ন, মধুমতি, এসবিএসি, প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোয় সাধারণ সঞ্চয় রাখলে দুই শতাংশ থেকে আট শতাংশ সুদ পাবেন গ্রাহক। মেয়াদি আমানতে মিলবে চার শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক মেয়াদি আমানতের ওপরে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে গ্রাহকদের।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে এনআরবি ব্যাংক। তিন থেকে ছয় মাস সময়ের সুদ পাঁচ শতাংশ থেকে ১০.৫০ শতাংশ, ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময়ের জন্য ৬.৫০ শতাংশ থেকে ১০.৭৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি। তিন বছরের বেশি সময়ের আমানতের সুদ মিলছে ১২ শতাংশ থেকে ১৩.৪৬ শতাংশ। সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসএবিসি) তিন মাস থেকে তিন বছর বা তার বেশি সময়ের ফিক্সড ডিপোজিটে ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
জানা গেছে, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্জিত অর্থ নানা উপায়ে অনেকেই ঘরে রেখেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বেশিরভাগই পলাতক। ঘরে টাকা রেখে তাদের কেউ কেউ এখন বিপদে আছেন। নিরাপদবোধ না করায় বিভিন্ন উপায়ে তারা ভালো ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন। আবার সরকার পতনের পর থেকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা তুলতে পারছে না মানুষ। এর কারণ, সরকার পতনের প্রথম সপ্তাহে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ, দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই লাখ এবং তৃতীয় সপ্তাহে তিন লাখ টাকা নগদ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ কারণে খারাপ অবস্থার ব্যাংক থেকে অনেকেই বড় অঙ্কের আমানত তুলতে পারছে না।
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কাটেনি। বিশেষ করে ইসলামী খাতের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পরিবর্তনের পর আমানতকারীরা আস্থাশীল ব্যাংকের দিকে স্থানান্তর হচ্ছিলেন। সেই সুবিধাটা পেয়েছে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকও। তা ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে জনগণ টাকা রাখলে লাভের পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। সার্ভিস চার্জ এবং ব্যাংকের চার্জ দিয়ে আর কোনো লাভ থাকে না। আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যে কোনো একটি সমাধানে যাওয়া উচিত। দীর্ঘদিন থেকে শুনছি, ব্যাংক ইকুইজিশন অ্যাক্ট এবং মার্জারের বিষয়ে আলোচনা চলছে। যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত না এলে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা নাও কমতে পারে। ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধির বিষয়টি সবসময় সুখকরও নয়। কারণ আমানত নিয়ে বিনিয়োগের জায়গা থাকতে হবে। শুধু আমানত নিলেই চলবে না, তার খরচ বহন করতে হবে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে গত ১০ বছর আগে থেকে বলে আসছি এস আলমের ব্যাংকে আপনারা টাকা রাখবেন না। কিন্তু আপনারা টাকা রেখেছেন। তারা দুই শতাংশ সুদ বেশি দিয়েছে, আপনারা সেখানেই টাকা রেখেছেন, এখন ধরা খেয়েছেন। এখন আমরা আপনাদের উদ্ধার করব; কিন্তু এখনই সেটি পারা যাবে না। আমরা ধাপে ধাপে করব; সেজন্য সময় দিতে হবে। আমরা ব্যাংক রেজুল্যুশন অ্যাক্টের দিকে যাচ্ছি, কিছু ব্যাংক একীভূত করতে হবে। অনেককিছু করা যাবে, করা হবে। এ বছরই হয়তো অনেককিছু করা হবে। এতটুকু বলতে পারি, আপনারা টাকা পান আর বন্ড পান, কিছু একটা পাবেন।’