
বাংলাদেশে বর্তমানে পাদুকা শিল্প যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। চামড়া এবং নন চামড়া উভয়ের বিনিয়োগে এ খাত হচ্ছে সমৃদ্ধ। প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এ খাতের রপ্তানি আয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে নন-লেদার বা কৃত্রিম চামড়া, রাবার ও প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি জুতার রপ্তানি বেড়েছে ১২০ শতাংশ। একই সময়ে চামড়ার জুতার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নন-লেদার জুতা রপ্তানি ৪০ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়ে ৩১৮ দশমিক শূন্য নয় মিলিয়ন ডলার হয়েছে। অর্থবছর শেষে তা আধা বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ জুতা উৎপাদনকারী দেশ হলেও গত অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি হয়েছে এক দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলার।
যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দেশের জুতা শিল্পে চামড়া ও নন-লেদার খাতের বিনিয়োগের সুযোগ হয়েছে সম্প্রসারিত। বিডার (বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ মাহবুব সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া গেলে জুতা শিল্প রপ্তানি আয়ের বড় উৎসে পরিণত হবে।’ বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে তারা রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছেন বলেও জানান। বিডার মতে, ক্রেতাদের পছন্দ ও পরিবেশগত কারণে নন- লেদার জুতার চাহিদা নতুন বিনিয়োগের সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি, গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে চামড়ার জুতার চাহিদাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এই খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে উল্লেখ করে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শুনিভার্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান যদি নন-লেদার জুতায় বড় বিনিয়োগ করে, তাহলে তা হবে লাভজনক।’
দেশে নীতিমালা মেনে চলা মানসম্মত নন- লেদার জুতা কারখানা আছে মাত্র ১৫টি। একটি নীতিমালা মেনে চলা মানসম্মত কারখানা স্থাপনে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার দরকার হয়। অনেক ট্যানারি ও জুতা কারখানা বিশ্বব্যাপী পরিবেশ এবং শ্রমমান পূরণে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অভাবে শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ছে না। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানির সময় কাস্টমসে পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি জুতা পোল্যান্ড, তুরস্ক, আরব আমিরাত, জার্মানি, ভারত ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
দেশে সিনথেটিক উপকরণের সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থার অভাবে উৎপাদন খরচের পাশাপাশি রপ্তানির সময়সীমা বাড়ে। ফলে পিছিয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায়। শুল্ক বিভাগের অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত বন্দর সুবিধা ও জাহাজীকরণে দেরি হওয়ায় রপ্তানিকারকদের পড়তে হয় ঝামেলায়। নন লেদার জুতায় কিছু সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলে এ খাত হবে সমৃদ্ধ। দেশে বিদেশী বিনিয়োগে বস্ত্র খাত, টেলিকমিউনিকেশন, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কেমিক্যাল ও ওষুধ, নির্মাণ ও সার খাত এগিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চীন, নেদারল্যান্ডস, হংকং, নরওয়ে, ভারত, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে। প্রয়োজনীয় কিছু আর্থিক ও নীতিগত ব্যবস্থা সংস্কার করা গেলে এসব খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়ে যাবে। বিদ্যমান ব্যবসার পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। যেসব দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের সুযোগ দিতে হবে। বিশ্বের সব দেশের সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে দেয় নানা সুবিধা। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাজার এখন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিনিয়োগের ফলে তৈরি হয় কর্মসংস্থান, বাড়ে রাজস্ব, কমে যায় দারিদ্র্য।
বাংলাদেশের জুতাশিল্প প্রায় ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় আনছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৯৬ কোটি ডলারের জুতা। তার মধ্যে চামড়াবিহীন জুতা ৪১ দশমিক ৬৮ কোটি ডলারের। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ধরনের জুতা রপ্তানি ছিল ২৭ কোটি ডলার। পরের তিন বছরে সেটি বেড়ে ৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলোয় উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে পরের বছর রপ্তানি কমে ৩৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তারপর আবার বাড়তে থাকে। অবশ্য জুতা রপ্তানিতে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্সা এখনো খুবই কম। জুতা রপ্তানিতে চীন রয়েছে সবার ওপরে। বিশ্বে মোট জুতা রপ্তানির ৬০ শতাংশ করে চীন। এরপর রয়েছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, তুরস্ক, ভারত, বেলজিয়াম, ইতালি, কম্বোডিয়া ও স্পেন।
ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২৩ সালে ২ হাজার ২৪০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়েছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কোটি জোড়া জুতা রপ্তানি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৬৮ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর রপ্তানি হওয়া জুতার বড় অংশই চামড়াবিহীন। বিদায়ী বছরের জুতা উৎপাদন ও রপ্তানির তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।
চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সিইও আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘ ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে আফ্রিকায় চামড়াবিহীন জুতার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে জুতার বাজার ভারত ও চীনের দখলে। ফলে আমাদের সামনে অবারিত সুযোগ।’ চামড়াবিহীন জুতার বাজার ধরতে হলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে, এমন মন্তব্য করলেন আহসান খান চৌধুরী। তিনি আরও বলেছেন, ‘এখন আমাদের এই পণ্যে মূল্য সংযোজন ৪০ শতাংশ। আগামী দিনে এটিকে ৭৫ শতাংশে নিতে চাই। সে জন্য আমরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পশ্চাৎমুখী সংযোগশিল্পে বিনিয়োগ করছি।’
বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসায় চীন বাণিজ্যে তার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়া শুরু হয়েছে। আর বাংলাদেশের শ্রম তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় চীনা ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
আগামী দিনে চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতাকে বড় রপ্তানি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের ভেতরে জুতার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলায়ও জোর দেওয়া দরকার।