
দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন ভালোর দিকে কিন্তু ঋণ বিতরণে মন্দাভাব। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটও কাটছে না এখনো। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাত আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধির কারণেই ব্যাংক খাতের তারল্য বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ খাতের তারল্য আরও বাড়ানো যেত যদি পাচার ও দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা যেত। যারা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভয়াবহ ক্ষতি করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে তারা এখনো নানা জায়গা থেকে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এখনো অনেক ব্যাংক তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বেড়েছে সুদের হার। ব্যাংকের নগদ টাকার সংকট বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে। পণ্য বাজারের উচ্চ মূল্যে ভোক্তাদের অস্থিরতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে, আরও কমবে। পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে আরও ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি।
পলিসি ঠিক থাকলে বাজার ঠিক থাকবে। ব্যাংকের রিজার্ভ সম্পর্কে বলেছেন আমাদের রিজার্ভের পতন এখন আর নেই। একটু একটু করে বাড়ছে। আইএমএফের টাকা না এলেও নিজস্ব সক্ষমতায় আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি।
তিনি আরও বলেছেন আমাদের রেমিটেন্স এবং রপ্তানির প্রবাহ ভালো। রিজার্ভ-প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। রমজানের জন্য নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আমাদের দেশে যত সমস্যা, তা সাধারণত একসঙ্গে কোনো দেশে হয় না। রাজস্ব খাতের ব্যর্থতা এক বছরের সরকার কখনোই সমাধান করতে পারবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তিনি।
ব্যাংকের তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ বিদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচার। বিগত সরকারের আমলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি অবৈধভাবে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে ব্যাংক ডাকাতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেন। দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যারা ব্যাংকের টাকা লুট করেছে, আসলে তারা দেশের সাধারণ মানুষের টাকা নিয়েছে। তাই যেভাবে হোক তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে যারা জড়িত, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকা উদ্ধারে এস আলম গ্রুপের সব সম্পদ জব্দ করার কথা জানা গেছে। ব্যাংক থেকে যারা টাকা লুটপাট করেছে তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে।
পতিত সরকারের আমলে ব্যাংক ডাকাত তথা অর্থ পাচারকারীরা যে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, নানা অনুসন্ধানে ক্রমেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থ পাচারের সুবিধার্থে এদের অনেকে আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গেও জড়িত। নাম-পরিচয় গোপন রাখতে বদলে ফেলেছে জাতীয়তাও। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে করেছে পঙ্গু।
বলা বাহুল্য, দেশের ব্যাংক খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতার জন্য অর্থ পাচার অনেকাংশে দায়ী। সন্দেহ নেই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অর্থ পাচার অন্যতম প্রতিবন্ধক। অর্থ পাচারকারীদের ধরতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব হবে, সময়ই তা বলে দেবে। তবে একথা ঠিক, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অসম্ভব নয়। যারা অর্থ পাচার করে থাকে, তাদের অধিকাংশই বেনামে ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করেছে। নানা স্তরে এদেরও রয়েছে সহযোগী। তাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। ব্যাংকের নগদ টাকার স্বাভাবিক লেনদেন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো এবারও মুদ্রানীতিতে সংকোচনমুখী ধারাই অনুসরণ করেছে।
এদিকে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের চড়া সুদ অব্যাহত রাখার কৌশলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এতে বিনিয়োগ হবে সংকোচিত। ব্যবসার বিকাশ হতে পারে বাধাগ্রস্ত। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত উদ্বেগজনক। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির কঠোর অবস্থানের ফলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ হতে পারে বাধাগ্রস্ত। তাদের মতে, উচ্চ সুদের হার ঋণের গতি কমিয়ে দেবে; পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার আরও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হলেও কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর ২০২৪ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এই লক্ষ্যমাত্রার ফলে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। বিনিয়োগের পরিবেশের কথা বলতে গেলে, অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা মনে করেন রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত নতুন করে বিনিয়োগে যাওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ যেতে চাইছেন না। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এখন দ্বিধাগ্রস্ত। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের অর্থছাড় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। দেশের বিদ্যমান উদ্যোক্তাদতারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছে না। অনেকের বড় ধরনের ব্যাংক ঋণ রয়েছে, সুদহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে উদ্বেগও বাড়ছে। সরকার স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এ কারণে এখন নতুন বিনিয়োগের চিন্তা কেউ করছে না। যে কয়জন উদ্যোক্তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, তারাও এখন ভয়ে আছেন। ফলে উৎপাদন ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যবসার পরিস্থিতি বিবেচনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও তার পরিবেশ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের জোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।