
.
রমজানের সপ্তাহখানেক আগেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে বেড়ে গেছে ইফতারির প্রধান উপকরণ খেজুরের দাম। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা ও মাছ-মাংসসহ বেশকিছু নিত্যপণ্যের দামও বাড়তির দিকে রয়েছে। এ ছাড়া লেবু ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি যেমন উচ্ছে, করল্লা, কাঁচকলা ও বেগুন বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। অর্থাৎ রমজানের আগে চড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার। অভিযোগ রয়েছে, রোজা সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। আগামী ১ মার্চ থেকে পবিত্র রমজান শুরু হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রোজার আগেভাগে শক্তভাবে বাজার মনিটরিং এবং অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে নিত্যপণ্যের দাম কমানো এবং টিসিবিকে আরও সক্রিয় করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
শুল্ককর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ও অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে আনায় রমজানকে ঘিরে এবার প্রায় দ্বিগুণ খেজুর আমদানি হয়েছে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে দাম সেভাবে কমেনি। বরং শুক্রবার সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুরে ২০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৬০০ টাকায়। অন্যদিকে, রমজান সামনে রেখে আরেক দফা বেড়েছে সব ধরনের চাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের দাম। তবে ছোলার দাম কিছুটা কমেছে বলে
জানিয়েছে টিসিবি। ডাল, আটা, চিনি ও মুরগির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও গ্রীষ্মকালীন সবজি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। রোজার আগে বেড়েছে লেবুর দাম। প্রতিহালি কিনতে ভোক্তাকে ৬০-৮০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
রমজান মাসে চাহিদা বাড়ে এমন ৯ ধরনের ভোগ্যপণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। গত অক্টোবর-জানুয়ারি সময়ে আগের বছর একই সময়ের তুলনা ছোলা আমদানি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ, খেজুর ২৩ শতাংশ, চিনি ২০ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, পবিত্র রমজান সামনে রেখে ৯ ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানিতে গড়ে ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পণ্যগুলো হলো চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, মটর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও খেজুর। এর মধ্যে ছোলা ও মটর ডালের আমদানিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বাজারে সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক ও পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে সহায়ক হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নগদ জমার হার নির্ধারণ ও বিলম্বে আমদানি বিল পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার কারণে এসব পণ্যের আমদানিতে আগ্রহ বেড়েছে ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি এই চার মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। উল্লিখিত সময়ে সয়াবিন তেলের আমদানি ৩৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৫২ টনে। ছোলা আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ৫৫৫ টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৪ শতাংশ বেশি। খেজুরের আমদানি ২৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৪২০ টন।
যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাড়ছে খেজুরের দাম ॥ অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে শুল্কায়ন করায় খেজুরের দাম কম হওয়া উচিত। কিন্তু শুক্রবার টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, রোজা সামনে রেখে খেজুরের দাম বেড়ে গেছে। ইফতারির অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ খেজুর ও ছোলা। ব্যবসায়ীরা এই চাহিদাকে পুঁজি করেই খেজুরের দাম বাড়িয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিতে সব ধরনের কর ও ভ্যাট সুবিধা দেওয়া হলে কেন দাম বাড়বে? সরকারের কঠোর বাজার মনিটরিং প্রয়োজন। প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিয়ে খেজুরসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে হবে। একাধিক ব্যবসায়ীর তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মাবরুম (সৌদি আরব) খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা, বর্তমানে মিসর থেকে আমদানি হওয়া প্রতি কেজি মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯২০-৯৬০ টাকা দামে, সবচেয়ে কমদামি নরম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫৫-১৬০ টাকা কেজি দামে।
দাম কমানোর লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সব ধরনের খেজুর আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর অব্যাহতি দেয়, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমায় এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে আনে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ৪৪ হাজার ২৫৩ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২০ হাজার ২৬৩ টন। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) তথ্য অনুসারে, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬০-৯০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, গত বছর কমদামি এবং বেশি দামি খেজুরের শুল্কায়ন যথাযথ না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নবিত্তরা। কারণ বাড়তি শুল্কায়নের ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক কম দামে কেনা খেজুর ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য কিনতে হয়েছে।
সয়াবিন তেলের সংকট কাটেনি ॥ বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট এখনো কাটেনি। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দোকান ঘুরেও বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। আর কবে নাগাদ বাজারে সরবরাহ ঠিক হবে, সেটিও জানাতে পারছেন না বিক্রেতারা। এই অবস্থায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম প্রতি লিটারে পাঁচ টাকা বেড়েছে। উল্লেখ্য, গত নভেম্বর মাস থেকেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। মাঝের সময়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানোর পরে সরবরাহের সংকট কিছুটা কমেছিল। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে আবার তীব্র হয়েছে এ সংকট। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে। এর পর গত রবিবার ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, আসন্ন পবিত্র রমজান সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকটের আশঙ্কা নেই। তবে শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
ছোলার আমদানি বেশি হলেও দাম কমছে না ॥ প্রতিকেজি প্যাকেট ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতের খোলা ছোলা ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে রোজায় ছোলার চাহিদা এক লাখ টন। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত আড়াই মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদনি হয়েছিল ৮৯ টন ছোলা। সেই হিসাবে এবার আমদানি গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ হাজার টন বা ৮০ শতাংশ বেশি হয়েছে। ইতোমধ্যে আরও ছোলা আমদানির পথে। আমদানি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজান সামনে রেখে গত জানুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় আটটি খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছোলা, ডাল ও মটর রয়েছে। এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুবিধায় আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এসব পণ্য আমদানি করা যাবে। এই সুযোগ দেওয়ার পর আমদানিকারকদের অনেকের মধ্যে ছোলা আমদানির আগ্রহ তৈরি হয়।
সরকারের অন্যান্য উদ্যোগ ॥ রমজানে সাধারণ ভোক্তা ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ এবং খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার সম্প্রতি সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, রমজানে প্রতিকেজি ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির মাংস ২৫০ টাকা, প্রতি লিটার পাস্তুরিত দুধ ৮০ টাকা, প্রতি ডজন ডিম ১১৪ টাকা এবং প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। এ ছাড়া সারাদেশে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পাস্তুরিত দুধ, গরু ও খাসির মাংস সুলভ মূল্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে। ঢাকা শহরে ২৫টি জায়গায় বিক্রি করা হবে।
এদিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী মার্চ ও এপ্রিল মাসে তিন লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে বলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে জানিয়েছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। এ কর্মসূচিতে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে ৫০ লাখ পরিবারকে। পাশাপাশি ঈদের সময় এক কোটি পরিবারকে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। ঢাকা মহানগরীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে তিনটি দল গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রমজানকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আরও নিবিড়ভাবে তদারকি করতে দলনেতাদের নির্দেশ দেন আব্দুর রহিম খান।