
নিত্যপণ্যের বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট এখনো কাটেনি
নিত্যপণ্যের বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট এখনো কাটেনি। বরং রমজান সামনে রেখে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে ভোজ্যতেলের। অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে অস্থিরতা বাড়ছে ভোজ্যতেলের বাজারে। কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বাজারে এখন যেটুকু তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, সেখানে অন্যপণ্য কেনার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে ভোজ্যতেল কোম্পানির পরিবেশকরা। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা পর্যায়েও। অনেক দোকানদার ভোজ্যতেলের সঙ্গে লবণ, মুড়ি, সাবান, নুডুলস এবং অন্যান্য পণ্য কিনতে বাধ্য করছে। এ অবস্থায় রোজার আগে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বাজারে ভোজ্যতেলের প্রকৃত কোনো সংকট নেই দাবি করে বলে, বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাসে আগে সয়াবিন তেলের চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন সরবরাহকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ২০২৪ সালে ভোজ্য তেলের আমদানি ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়েছে। তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সরবরাহ বাড়িয়েছে। কিন্তু এরপরও বাজারে ভোজ্যতেলের তীব্র সংকট কাটছে না। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের তেলের বোতলের জন্য এখন তীব্র হাহাকার। তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো দাবি করছে, তারা বাজারে সরবরাহ বাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা দ্বিমত জানিয়ে বলছেন, কোম্পানিগুলি চাহিদার তুলনায় কম তেল সরবরাহ করছে।
সংকটের মধ্যে ব্যবসায়ীরা লিটারপ্রতি অতিরিক্তি ১৫-২০ টাকা দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন। এমন পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শুরু করেছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। উল্লেখ্য, গত ৯ ডিসেম্বর থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে বুধবার ঢাকায় সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন বলেন, ভোজ্য তেলের বাজার সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে স্থিতিশীল হবে। তবে কমিশন ও সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও ভোক্তা অধিকার গোষ্ঠীগুলো সন্দিহান আছেন। তবে ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কৃত্রিম।
এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কমিশন জানিয়েছে, ভোজ্য তেল আমদানিতে বেড়েছে ৩৫ শতাংশ, তার সঙ্গে বেড়েছে ঋণপত্র (এলসি) খোলাও। জানুয়ারিতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানিয়েছে কমিশন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২৪ সালে ক্রুড পাম তেল ও ক্রুড় সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার ১৭৬ টন। ২০২৩ সালে এই আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৭৩ টন। অর্থাৎ ২০২৪ সালে ২০২৩ সালের তুলনায় ৮১ হাজার ৫০৩ টন ভোজ্য তেল বেশি আমদানি হয়েছে। কিন্তু আমদানি বৃদ্ধি সত্ত্বেও দোকানদাররা বলছেন, তারা চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না, বিক্রয় প্রতিনিধিরাও যথাযথভাবে সরবরাহ দিতে পারছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দোকান মালিকরাদের চাহিদা অনুযায়ী তেল অর্ডার নিচ্ছেন না বিক্রয় প্রতিনিধিরা। ১০ জানুয়ারি থেকে দোকানগুলোতে বিক্রয় প্রতিনিধিদের দেখা মিলছে না বলেও দাবি করেন তারা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোজ্য তেল আমদানি হয়। এছাড়া মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়েও আমদানি হয় ভোজ্য তেল। কয়েকটি শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন প্রায় ১৪টি প্রতিষ্ঠান সব ভোজ্যতেল আমদানি করে।
ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি ট্যারিফ কমিশনের সভা কক্ষে একটি বৈঠক করে কমিশন। সেখানে বিভিন্ন ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী কোম্পানিকে ডাকা হয়। ওই বৈঠকে কোম্পানিগুলো দাবি করে, বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ সংকট নেই। আমদানিও বেড়েছে আগের তুলনায়।
জানুয়ারিতে সয়াবিন তেলের সরবরাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে ট্যারিফ কমিশনের উপপ্রধান (বাণিজ্য নীতি বিভাগ) মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, তেল আমদানিকারকদের আমদানি ও উৎপাদন তথ্য অনুযায়ী বাজারে তেলের সংকট থাকার কথা নয়। কোম্পানিগুলো বলছে তারা কোনো ধরনের কারসাজি করছে না।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভোক্তা পর্যায়ে বোতলজাত তেলের সংকট আছে। কমিশন আরও জানিয়েছে, আগামী রমজানকে কেন্দ্র করে প্রায় দেড় লাখ টন তেল আমদানির অপেক্ষায় আছে। তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো আশ্বস্ত করেছে, রমজানে তেলের দাম বাড়বে না।