![মুদ্রাস্ফীতির জন্য পোলট্রি শিল্পকে অযথা দোষী করা হয়েছে মুদ্রাস্ফীতির জন্য পোলট্রি শিল্পকে অযথা দোষী করা হয়েছে](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/33-2502131258.jpg)
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ভোক্তারা চরম মূল্যস্ফীতির শিকার হয়েছে। বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বারবার কথিত 'সিন্ডিকেটকে' দোষারোপ করেছেন মুরগি, ডিম এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ কয়েকটি বড় পোলট্রি কোম্পানিকে জরিমানা করার নির্দেশ দেয়। যদিও হাইকোর্ট সেই আদেশ স্থগিত করেছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিম ও মুরগির সর্বোচ্চ মূল্যসীমা নির্ধারণ করে। কিন্তু যেকোনো শিল্পে দাম বেঁধে দেওয়া হলে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয় এবং বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। কারণ, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির অভাবে সরবরাহ কমে যায়, ফলে দাম উচ্চ পর্যায়েই থেকে যায়।
এই সার্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ হয়নি। অথচ মূল্যস্ফীতি একটি সুপরিচিত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, যার নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সেগুলো বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
মূল্যস্ফীতির প্রথম কারণ হতে পারে ঘাটতি। যখন কোনো পণ্যের সরবরাহ কমে যায়, তখন ভোক্তারা সেটি পাওয়ার জন্য বেশি মূল্য দিতে বাধ্য হয়। ফলে বাজারমূল্য বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিবিদরা একে 'সরবরাহজনিত ধাক্কা' (supply shock বলে থাকেন।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে বিশ্ববাজারে এই পণ্যগুলোর সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বেড়ে যায়; যা পোলট্রি, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্যের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ২০২২ সালে পোলট্রির খাদ্য ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ সিন্ডিকেট নয়, বরং ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সরবরাহ সংকট।
দ্বিতীয় কারণটি অর্থনৈতিক অপব্যবস্থাপনা। যখন সরকার মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রা ছাপায়, তখন সকল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অতিরিক্ত টাকা ছাপানো হলে টাকার মূল্য কমে যায় এবং পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি বাজারে থাকা টাকার পরিমাণ হঠাৎ ৫০ শতাংশ বুদ্ধি পায়, তাহলে একটি ৮ টাকার ডিমের দাম ১২ টাকায় উঠে যেতে পারে। এটিকে বলা হয় (monetary inflation) বা মুদ্রাস্ফীতি; যা কোনো সিন্ডিকেটের কারণে হয় না, বরং এটি অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফল। সাধারণত, সরকার রাজস্ব আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় করলে এবং সেই ঘাটতি (যাকে বাজেট ঘাটতি বলা হয়) পুষিয়ে নিতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ প্রকাশিত Monthly Economic trends (অক্টোবর ২০২৪) থেকে জানা যায় যে, ২০২০ সালের জুন মাসে দেশে প্রচলিত মুদ্রার (Currency in Circulation) পরিমাণ ছিল ২০৮,০৯৪ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১১,৯৪৮ কোটি টাকায়। মাত্র তিন বছরে বাজারে প্রচলিত মুদ্রার পরিমাণ ৪৯ শতাংশ বুদ্ধি পেয়েছে। ফলে ৮ টাকার
ডিমের দাম ১২ টাকায় ওঠা স্বাভাবিক। একইভাবে, চাল, সবজি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও এই সময়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, সার্বিক মূল্যস্ফীতির মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত টাকা ছাপানো, যা সাধারণ জনগণকে গরিব করেছে।
প্রশ্ন হলো- বিগত সরকার কেন অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিল? এর উত্তর খুবই স্পষ্ট: বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার জন্য সরকার নির্বিচারে টাকা ছাপিয়েছে। যদি এটি না করা হতো, তাহলে এসব ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেত, যার ফলে লাখ লাখ পরিবার তাদের সঞ্চয় হারাত এবং দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে মন্দার কবলে পড়ত।
যে-সব রাজনীতিবিদ ব্যাংক খাতের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী, তাঁরা কখনোই স্বীকার করবেন না যে তারা অর্থনীতির এমন ক্ষতি করেছেন। বরং তাঁরা মূল্যস্ফীতির জন্য অন্য কাউকে দোষারোপ করার সহজ উপায় খুঁজেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা পোলট্রি শিল্পকে সেই বলির পাঁঠাবানিয়েছে। ডিম ও ব্রয়লার মুরগি সাধারণ মানুষের প্রধান প্রাণিজ প্রোটিন, তাই এই খাতকে দোষারোপ করা সহজ হয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশনের কর্মকর্তারাও মন্ত্রীদের পথ অনুসরণ করেছেন। এর ফলে পোলট্রি খাতে একপ্রকার 'ব্যবসাবিরোধী' পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সংকট কীভাবে সমাধান করা হবে? অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি করতে হয়, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে করেছে। তবে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য টাকা ছাপানোও বন্ধ করতে হবে। পোলট্রি খাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রতিযোগিতা কমিশনের অন্যায্য মামলা প্রত্যাহার করা উচিত। একইসঙ্গে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যসীমা বাড়ানো বা পুরোপুরি তুলে দেওয়া দরকার, যাতে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতির সরবরাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী দাম কমে আসবে। এটি যে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপের চেয়ে বেশি কার্যকর এবং টেকসই সমাধান হবে।
সজিব