ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

প্রতিভরি প্রায় দেড় লাখ টাকা, বাড়ছে বিনিয়োগ

সর্বোচ্চ রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে সোনা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সর্বোচ্চ রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে সোনা

সর্বোচ্চ রেকর্ড সোনা

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড দামে প্রতিভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকায়।  অতি মূল্যবান যে সোনা আগে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করতেন ভোক্তারা, তাই এখন হয়ে উঠছে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম। আর এ কারণেই হু হু করে বাড়ছে সোনার দাম।

এখন শুধু বিয়ে-শাদি কিংবা প্রিয়জনের উপহার হিসেবেই সোনার ব্যবহার হচ্ছে না, বরং বিশ্ববাপী বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে সোনা। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ধরে মানুষ সোনা কিনে মজুত করে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। এতে করে লাভবান হচ্ছে সোনার ক্রেতারা। 
সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম এক লাখ ৪৯ হাজার ৮১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে তৃতীয়বারের মতো দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হলো। যেভাবে দাম বাড়ছে এটা অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে দেড় লাখ টাকা পেরিয়ে যাবে স্বর্ণের ভরি।

স্থানীয় বাজারে তেজাবী সোনার (পাকা সোনা) দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে এই দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটি বৈঠকে করে এই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাম বাড়ানোর তথ্য জানানো হয়।
ভালোমনের সোনার রেকর্ড দাম হওয়ার পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে অন্যান্য সোনার দামও। ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ হাজার ৯০২ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪৩ হাজার ১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ হাজার ৬৩৩ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম ১ হাজার ৩৮৮ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৯১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের বাজারে এই প্রথম সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেল। এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ২ হাজার ৯২৮ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৮ টাকা। ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ২ হাজার ৭৯৯ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ২ হাজার ৪০৩ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৪৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম ২ হাজার ৫৩ টাকা বাড়িয়ে ৯৯ হাজার ৫২৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সোমবার পর্যন্ত এ দামেই সনাতন পদ্ধতির সোনা বিক্রি হয়েছে। এদিকে সোনার দাম বাড়ানো হলেও অপরিবর্তিত রয়েছে রূপার দাম।

২২ ক্যারেটের এক ভরি রূপার দাম ২ হাজার ৫৭৮ টাকা, ২১ ক্যারেটের এক ভরি রূপার দাম ২ হাজার ৪৪৯ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি রূপার দাম ২ হাজার ১১১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির এক ভরি রূপার দাম ১ হাজার ৫৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে সোনার। এমনকি চলতি সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম সর্বকালীন রেকর্ড আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৭৪৮ ডলারে উঠে যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোনায় বিনিয়োগের বিভিন্ন মাধ্যম আছে, সেসব দেশে মানুষ কেবল গয়না বা বার কেনেন না। সোনায় বিনিয়োগের আরেকটি মাধ্যম হলো ডিজিটাল সোনা। অনেক দেশে সোনার দোকান ও বিনিয়োগকারী সংস্থার অনলাইন সাইট থেকে ডিজিটাল সোনা কেনা যায়। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাকে মজুরি দিতে হয় না ও সোনা খাঁটি কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে না। এত সুবিধা হলো কোথায় সোনা রাখা হবে, তা নিয়েও ভাবতে হয় না। প্রতি মাসে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে এই ডিজিটাল সোনা কেনা যায়। কোনো কোনো দেশে গোল্ড বন্ডও আছে।

এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা হাতে সোনা না পেলেও সোনায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। এই বন্ডের মেয়াদ ও সুদহার নির্ধারণ করা থাকে। মেয়াদের আগেও কেউ এই বন্ড ভেঙে ফেলতে পারেন। বিনিয়োগের দিক থেকে এই পদ্ধতি বেশ সুরক্ষিত। প্রথাগত গয়না কেনার পাশাপাশি সোনার কয়েন বা বার কেনা যায়। সে ক্ষেত্রে হলমার্ক চিহ্ন যাচাই করে সোনা কিনতে হয়।

সরাসরি সোনা কেনার সময় এটাও ভেবে দেখা উচিত, এই সোনা আবার বিক্রি করতে হতে পারে। সে জন্য কোথা থেকে সেই সোনা কেনা হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য বিশ্লেষকদের পরামর্শ, বিশ্বাসযোগ্য জায়গা থেকে সোনা কেনা উচিত।
সোনার দাম কেন বাড়ে ॥ যেসব কারণে চলতি বছর সোনার দাম বেড়েছে, তার মধ্যে আছে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা। ভারত ও চীনের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার-নির্ভরতা হ্রাসও সোনার মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা দোকান কস্টকো এক আউন্সের বুলিয়ন বার বাজারে ছাড়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে আর ১০টা পণ্য কেনার মতো সোনার বার কেনাও সহজ হয়েছে।

ফলে সোনার পালে রীতিমতো হাওয়া লেগেছে। এই প্রবণতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। অতীতেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেছে। সোনা কেনার মূল প্রণোদনা হলো মানুষ মনে করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্টক, বন্ড বা মুদ্রার তুলনায় সোনা থেকে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। 
অর্থনীতি নিম্নমুখী হলে সোনা প্রকৃত অর্থেই সোনা ফলাবে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল অর্থাৎ পশ্চিমা পৃথিবীতে আর্থিক মন্দার সময় সোনার দাম নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুসারে, সোনার প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্স বা পিপিআইয়ের মান এই সময় ১০১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছিল। ওই সময় অনিশ্চয়তা ছিল তুঙ্গে।

স্বাভাবিকভাবে তখন সোনার দাম বেড়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, সোনা তেল ও গ্যাসের মতো শেষ হয়ে যায় না। নানা হাত ঘুরে সোনা শেষমেশ পৃথিবীতেই থাকে। তাই সোনার স্থায়িত্ব আছে। অন্যদিকে পৃথিবীতে সোনার মজুত নির্দিষ্ট পরিমাণেই আছে। সাধারণত বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় সেই পণ্যের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। সোনার দামে জোগানের চেয়ে ভোক্তার আচরণ বেশি প্রভাব ফেলে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের মতো চলতি বছরও বিশ্ববাজারে সোনার দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বের প্রধান ব্যাংকগুলো। ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা সোনায় বিনিয়োগ বাড়াবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি। এই প্রেক্ষাপটে স্বল্পমেয়াদে সোনার দামের পূর্বাভাস সংশোধন করেছে বৈশ্বিক আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক। তারা বলছে, এ বছর সোনার দাম আউন্সপ্রতি তিন হাজার ডলারে উঠে যেতে পারে।

পূর্বাভাসে সিটি ব্যাংক আরও বলেছে, ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ডলারে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে ২০২৫ সালে সোনার গড় দাম থাকতে পারে আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ ডলারের মধ্যে। এক নোটে সিটি ব্যাংক জানায়, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বাণিজ্যযুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে।

এতে উদীয়মান বাজারে সরকারি খাতে সোনার চাহিদা বাড়বে, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা কেনা বৃদ্ধি করবে। ডি-ডলারাইজেশন এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো দেশ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও লেনদেনে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে।

×