![মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা নীতি মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা নীতি](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/4-2502081255.jpg)
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশের প্রথম দিকেই তাঁর প্রশাসন প্রায় সব বিদেশী সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত করেছে। এই সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা পর্যালোচনা ও সম্ভবত সংস্কারের পরিকল্পনারও ইঙ্গিত। প্রাথমিক কাটছাঁট ও স্থগিতাদেশের অংশ হিসেবে হোয়াইট হাউস বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সব প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ বা স্থগিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই সহায়তা স্থগিতাদেশ ৯০ দিনের জন্য কার্যকর থাকবে। তবে সহজেই অনুমেয় যে, এটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক সহায়তার প্রতি অনীহা রয়েছে এবং ৯০ দিনের মধ্যে সব সহায়তা কর্মসূচির বিস্তৃত পর্যালোচনা সম্ভব হবে না। তবে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য দেওয়া সহায়তা এই স্থগিতাদেশের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীরা গত বছর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সত্যিকার অর্থেই সংস্কার ও পুনর্গঠনে নিবেদিত। এখন সহায়তা বন্ধ হলে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। উল্লেখ্য, বিদেশে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই দেশটির অর্থায়নে চলমান প্রকল্পের কাজ বন্ধ বা স্থগিত করা হয়েছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মীদের হোম অফিস করার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
কর্মসূচির ব্যাপ্তি ও বিপুল কর্মী সংখ্যার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি ও অলাভজনক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক। বাংলাদেশভিত্তিক সংস্থাটির কাজ রয়েছে বিশ্বের কয়েকটি দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার পর বাংলাদেশসহ মোট চারটি দেশে নয়টি কর্মসূচি স্থগিত করেছে সংস্থাটি। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, বাংলাদেশে মার্কিন অর্থায়নের ছয়টি প্রকল্প স্থগিত করেছেন তারা। ‘এর মধ্যে তিনটি প্রজেক্ট সরাসরি আমরা বাস্তবায়ন করি, তিনটি অন্য এনজিও দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছিল। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান ও লাইবেরিয়াতে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চলমান তিনটি প্রজেক্টও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ‘ডাইভারসিটি ইনক্লুশনের (বৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্তি) প্রজেক্ট থাকলে বন্ধ করতে বলা হয়েছে। আমাদের নির্দিষ্টভাবে ডাইভারসিটি ইনক্লুশনের প্রোগ্রাম নাই। ফলে একেবারে বন্ধ বা বাতিল করতে হয়নি। কিন্তু ডিরেক্ট ফান্ডের প্রজেক্টগুলো আপাতত স্থগিত রাখতে হয়েছে। এসব প্রকল্প থমকে যাওয়ার কারণে অন্তত পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন বলে জানান তিনি। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মনে করেন, যদি পর্যালোচনার পর প্রকল্পগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়, সেটি ছোট এনজিওগুলোর জন্য একটা বড় ধাক্কা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলের ওপর নির্ভরশীল আরেকটি উন্নয়ন সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের দুটি প্রকল্প আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক সহায়তায় পরিমাণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতি বছর দেওয়া সহায়তার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর আগের বছরগুলোতে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ মিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এই সংখ্যাটা প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার। ইউনাইটেড স্টেটস্ এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএইড)-এর তথ্য বলছে, এই অর্থ যেসব খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বৃহত্তম বাজার। কিন্তু ট্রাম্পের প্রশাসনের লেনদেনভিত্তিক নীতির ফলে বাণিজ্য শর্তাবলিতে পরিবর্তন আনার আশঙ্কা রয়েছে। যদি মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার বা শুল্কনীতি রাজনৈতিক শর্তের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে এটি বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নতুন বাণিজ্য অংশীদার খুঁজে বের করার একটি সুযোগ হতে পারে, তবে এটি বাস্তবায়ন করতে সময় এবং কৌশলের প্রয়োজন। আর্থিক এবং কৌশলগত সম্পর্কগুলো পুনর্গঠন করা এবং বিকল্প আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশকে অবশ্যই উন্নয়ন নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে কোনো একক দাতা দেশের ওপর নির্ভরতা কমে আসে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের শর্তের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন কিন্তু অপরিহার্য পদক্ষেপ। উন্নয়ন, কূটনীতি এবং কৌশলগত সিদ্ধান্তের এই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বাংলাদেশের নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে দেশের স্বার্থকে রক্ষা করা, বৈশ্বিক প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই প্রক্রিয়া জটিল হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রেখে এই প্রতিকূলতাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে সক্ষম হবে।