![ফুল বাণিজ্য ফুল বাণিজ্য](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/3-2502081251.jpg)
বিশুদ্ধতার প্রতীক ফুল। প্রকৃতির চারপাশে প্রতিনিয়ত ফোটে নানা জাতের ফুল। রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, হাসনাহেনা, বেলি, গাঁদা বিভিন্ন নামের পরিচিত ফুলের পাশাপাশি বিদেশী ফুলও এখন দেশের মাটিতে ফোটে। বিদেশী ফুলের মধ্যে চাহিদার প্রথমেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ ফুল। তবে বিক্রির দিক থেকে গোলাপ সবার আগে। ফুলের রানী বলে কথা! এ ছাড়া ফুলের দোকানে গ্লাডিওলাস, জিপসি, চায়না গোলাপ, কসমস, চেরিসহ আরও কয়েক জাতের ফুল বিক্রি হতে দেখা যায়। সারা বছর দিবস ছাড়াও বিয়ে, জন্মদিন, পার্টি বা যে কোনো আনন্দ আয়োজনে ফুলের বাণিজ্য থাকে রমরমা। রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ও অন্যান্য অনুষ্ঠান ফুল ছাড়া প্রায় অচল। এক সময় ফুল কেবল শৌখিন মানুষের বাগানে বা টবে চাষ হতো। শখ করেই ফুলগাছ রোপণ করত। সেই শখ এখন অর্থ উপার্জনেরও পথ তৈরি করেছে। অর্থাৎ ফুল এখন একটি অর্থকরী ফসল। যা অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। দেশের গণ্ডি পার হয়ে ফুল যাচ্ছে বিদেশেও। ফুলের চাহিদা বাড়ায় সারাদেশে ফুলের দোকানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মও ঝুঁকছেন ফুল চাষ ও বিপণনে। বিদেশে রয়েছে ফুলের বিশাল বাজার। তাই ফুলের রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হলে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি হবে আরও বিস্তৃত। ইতোমধ্যে আমাদের ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, চীন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রপ্তানি হচ্ছে।
বছরের অন্য সময়ের তুলনায় বসন্ত এলেই ফুলের বাজার হয় চাঙ্গা। এ ছাড়াও ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই চার মাসে বিভিন্ন দিবস থাকায় ফুলের ব্যবহার বাড়ে ব্যাপকভাবে। বসন্ত, ভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পাড়া-মহল্লাতেও অস্থায়ীভাবে গড়ে উঠে ফুলের দোকান। বর্তমানে ফুল বিক্রি করেই চলে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা। সে কারণেই ফুল এখন পরিণত হয়েছে একটি শিল্পে।
বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ফুল দেশে উৎপাদন হচ্ছে। আমরা জানি, ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে গদখালী ইউনিয়ন। যা বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। এই ইউনিয়নে ১৯৮২ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু হয়। বর্তমানে দেশের মোট ফুলের ৭০ শতাংশ উৎপাদন হয় গদখালীতে। যা থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে উৎপাদন হয় বেশি। আর ফেব্রুয়ারিতে বিক্রয় বেশি।
চলতি মাস উপলক্ষে ফুল চাষে সরব হয়ে উঠেছেন গদখালীর ফুলের চাষিরা। কারণ হাতে রয়েছে আর মাত্র কয়েক দিন। এ তিন দিবসে অন্তত শত কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন স্থানীয় চাষিরা। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয় এবং এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক মানুষ জড়িত। আসন্ন বসন্ত, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ব্যাপক ফুল বিক্রি হলে চাষিদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। নাভারণ ও পানিসারা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে নানা জাতের ফুল। এই অঞ্চলের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছে গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গাঁদা, লিলিয়াম, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ অন্তত ১৩ ধরনের ফুল। হঠাৎ গরম পড়ায় ফুল ফুটে যাওয়ায় বাজারে ফুলের জোগানও বেশি। অন্যান্য ফুলের দাম কিছুটা কম হলেও ঊর্ধ্বমুখী গোলাপের দাম। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ফুলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। যে গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৫ টাকা দরে। আজ সেই গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৮ খেকে ১০ টাকায়। জারবেরা প্রতি পিস প্রায় ১০ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক প্রতি পিস ৮ থেকে ১০ টাকা, জিপসি আঁটি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাঁদা প্রতি হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, গ্লাডিওলাস রং ভেদে ৮ থেকে ১২ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা প্রতি পিস প্রায় ৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে উৎসব যত ঘনিয়ে আসছে ফুলের দাম ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২২ সালে ৩২ হাজার টনের বেশি ফুল ফুটেছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির তথ্য বলছে, দেশে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার রয়েছে।
দেশের ফুলের চাহিদার বেশিরভাগ আসে যশোর ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে। যশোরের গদখালী তো ফুলের জন্যই ব্যাপক পরিচিত এলাকা। তবে ফুল চাষ, সংরক্ষণ ও বিপণনে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে এ বাজার আরও সম্প্রসারণ করা সম্ভব। সার্বিকভাবে ফুল শিল্পের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- ফুল চাষ ধান ও শাকসবজির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। এ ছাড়াও ফুলের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি, হেক্টরপ্রতি অধিক লাভ, ফুলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যান্য জেলায় ফুলের চাষ বৃদ্ধির সুযোগ এবং মানুষের মধ্যে ফুল ক্রয়ের অভ্যাস ও উৎসাহ বেড়ে যাওয়া।
ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে পাইকারি ফুলবাজার রয়েছে। এখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা ফুল কিনে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েন। কেন্দ্রীয় ফুলবাজার নির্মাণের দাবি বহু আগে থেকেই করে আসছেন ফুল বিক্রেতারা। ফুল উৎপাদন আরো বাড়াতে হলে প্রযুক্তির ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহনকালে ফুল জাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুলের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন এবং দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা দরকার। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা কর্তৃক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন একান্ত প্রয়োজন।