ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১

চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা

আ. ফ. ম আব্দুল হাই

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা

বিগত বছরে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব, শ্রমিক ধর্মঘটে উৎপাদন বন্ধ ও ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন চা বাগান মালিকরা। অপরদিকে জ্যামিতিক হারে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পেলে ও নিম্ন মানের চা উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় কাক্সিক্ষত পরিমাণ চা রপ্তানি হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে চায়ের রপ্তানি বাজার। এই বাজার ধরে রাখতে চা বোর্ড বিভিন্ন ধরনের চা উৎপাদন করছে যেমন : ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি, মাসালা টি, জিনজার টি, লেমন টি, তান্দুরি টি ও হোয়াইট টি ইত্যাদি। জানা যায়, দেশের ১৬৯টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ক্ষুদ্রায়তনের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং পঞ্চগড় জেলা মিলে ৫৯ হাজার ১৮ হেক্টর জমিতে চা উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে কেবল মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে ৯০টি চা বাগান।
২০২৩ সালে চা শিল্পে ১৮৪ বছরের উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সালে ১৬৮টি চা-বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু গত বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। যদিও গত ডিসেম্বরের উৎপাদনের হিসাব এখনো সম্পন্ন হয়নি। চা বোর্ডের ধারণা, ডিসেম্বর মাসে ৮০ লাখ কেজি চা যোগ হতে পারে। এই ৮০ লাখ কেজি চা যোগ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ১২ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন কম হবে।
চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিরূপ আবহাওয়া বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা এবং মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা চা উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল ছিল। এ ছাড়া সার, সেচ ও কীটনাশকের উচ্চমূল্য এবং শ্রমিক ধর্মঘট চা উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং নিলামে চায়ের কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় গত চা মৌসুমে উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে হলে দেশের চা শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ, খরচ বৃদ্ধি এবং বাজারমূল্যের সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন চা সংশ্লিষ্টরা।
এ বছর চায়ের উৎপাদন কম হওয়ায় চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে ৩০টি নিলাম বাজারে চা সরবরাহ কমেছে। এ বছর নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ২১০ টাকা ৫৬ পয়সা। গত বছর ছিল ১৯২ টাকা। সরবরাহ কমে যাওয়ায় চায়ের দাম এবার কিছুটা বেড়েছে। গত বছর এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ছিল ২২৬ টাকা। এ বছর চা সংশ্লিষ্ট সব উপকরণের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। একদিকে চায়ের উৎপাদন কমেছে, অপরদিকে বেড়েছে ব্যয়। তাই এ বছর বাগান মালিকদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ন্যাশনাল ব্লেকার্সের সিনিয়র ম্যানেজার অঞ্জন দেব বর্মণ জানান, নিলামে গত বছরের চেয়ে এ বছর চায়ের সরবরাহ কমেছে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা সাড়ে ৯ কোটি কেজি চা পাতা। যে পরিমাণ চা পাতা বাগানে উৎপাদিত হবে দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
চা রপ্তানি কমে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিসির তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক ও টি প্লান্টার রাহেল রানা বলেছেন, ইউরোপসহ বিশ^ বাজারে এখন অর্থডক্স ও গ্রিন টির চাহিদা বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রধানত ব্লাক টি বেশি উৎপাদন হয়। এ ছাড়া উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আমরা চায়ের গুণগত মানের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি। পঞ্চগড়ের উৎপাদিত চা আমাদের সিলেটের চায়ের গড় মানের জন্য এখন হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে চা রপ্তানিতে আমরা আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না বলে তিনি মনে করেন।
এম আর খান চা বাগানের স্বত্বাধিকারী হারুন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের চা রপ্তানির জন্য প্রধান বাধা গুণগত মানের ঘাটতি। দেশের উত্তরাঞ্চলীয় বাগানগুলোতে নিম্নমানের চা নিলাম বাজার ঘুরে রপ্তানিতে গিয়ে মার খাচ্ছে। তিনি বলেছেন, আমাদের আধুনিক চা উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। অপরদিকে, ভারতের মতো দেশ তাদের চা উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণ করে চায়ের গুণগত মান উন্নত এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পেরেছে। শ্রীলঙ্কা গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও রপ্তানি ক্ষেত্রে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল গ্রহণ, ব্র্যান্ডিং, গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে চা রপ্তানি বৃদ্ধি ও বিশ^ বাজারে শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
চা বোর্ড শ্রীমঙ্গল প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বাংলাদেশে মানুষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রজাতীর কীটপতঙ্গের আবির্ভাব ঘটেছে। এসব কীটপতঙ্গ মোকাবিলায় যত্রতত্র রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারও বেড়েছে। কিছু চা বাগান মালিকরা অধিক উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে উৎপাদন বাড়লেও চায়ের গুণগত মান হারাচ্ছে।
সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর ও শ্রী গোবিন্দপুর চা হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহসিন মিয়া মধু বলেছেন, হু হু করে চায়ের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারিভাবে চায়ের দাম ১৬০ টাকা ন্যূনতম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বাগান মালিকদের এক কেজি চা তৈরিতে খরচ পড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। সেখানে নিলামে চা বিক্রি করতে হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে। এতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। ফলে ছোট ছোট চা বাগান মালিকদের টিকে থাকা নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। এতে করে চা উৎপাদনে বাগান মালিকরা কিছুটা হলেও আগ্রহ হারাচ্ছে। অন্যদিকে পঞ্চগড়ের উৎপাদিত নিম্ন মানের চা পাতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে উন্নত মানের চা প্রস্তুতকারী বাগানগুলো মার খাচ্ছে। গত মৌসুমে চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা কম হওয়ার এটাও ছিল অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক চা রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজনীতার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে এক সময় দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল অবস্থান। এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চা আমদানি করতে হচ্ছে। তবে রপ্তানি প্রণোদনার পাশাপাশি আমাদনি নিরুৎসাহিত করতে উচ্চ শুল্কারোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার পাকিস্তানে চা রপ্তানি সহজীকরণ করা হয়েছে। চায়ের মান উন্নয়নসহ রপ্তানি বৃদ্ধিতে সকল বাধা দূর করতে চা বোর্ড নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।

×