ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

১৫ দিনের মধ্যে ইমারত বিধিমালা চূড়ান্ত করতে হবে

বেআইনি ড্যাপ সংস্কার চায় রিহ্যাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১২:১৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বেআইনি ড্যাপ সংস্কার চায় রিহ্যাব

ছবি: জনকণ্ঠ

দ্রুত বেআইনিও ড্যাপ (২০২২-৩৫) সংস্কার এবং জনবান্ধন ইমারত বিধিমালা চূড়ান্তকরণের দাবি জানিয়েছে রিহ্যাব।

রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন,  স্বৈরাচার সরকারের প্রণীত বেআইনি ড্যাপ দ্রুত সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইমারড বিধিমালা চূড়ান্ত করতে হবে।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে।

লিখিত বক্তবে রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট বলেন, মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের সমস্যা সমাধানে সরকারের সাথে বড় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে আবাসন শিল্পের সদস্যদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করাই রিহ্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠান সমূহের লক্ষ্য। আমাদের কার্যক্রমের উপর নির্ভর করে প্রায় দুই শতাধিক এর অধিক লিংকেজ শিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। ২ কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই আবাসন শিল্পকে ঘিরে। রিহ্যাব সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই আজ শহরগুলোতে সুন্দর সুন্দর নান্দনিক ভবন তৈরি হচ্ছে। জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রাখছে এই খাত। আমাদের কার্যক্রম এবং আমাদের দেখানো পথে ঢাকায় প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ পরিবার নিজ ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। আমরা আবাসন ব্যবসায়ীরা বাকি নাগরিকদের জন্যও এমন সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন আবাসনের ব্যবস্থা করতে চাই। আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে।

তিনি  বলেন, আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি জনসংখ্যার তুলনায় আয়তনে অনেক ছোট। আর ঢাকা বিশ্বের জনবহুল মেগা সিটি। অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ লোকের আবাসনের ব্যবস্থা আমাদের করতে হচ্ছে বাস্তবতার কারণেই। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে জমি কম থাকায়। সব কিছু বিবেচনা করে এই সেক্টরের বিশেষজ্ঞগণ এবং সরকার অনেক যাচাই বাছাই সাপেক্ষে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ জারি করেন। সেখানে খাল-বিল জলাশয় সংরক্ষণ এবং রাস্তা প্রশস্থ করণের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অশুভ কোন উদ্দেশ্যে আবাসন খাতকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে পতিত সরকারের কতিপয় দোসরদের প্রেসক্রিপশনে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কোভিড মহামারি চলাকালীন তড়িঘড়ি করে দেশের স্বার্থ বিরোধী বেআইনী ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) প্রকাশ করে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মদদপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ কে উপেক্ষা করে ও মাষ্টার প্ল্যান-২০১০ কে অন্যায়ভাবে রহিত করে কেড়ে নেন ২০০৮ এর ফার অংশটুকু। সৃষ্টি করা হয় নগরবাসীর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য। এরপর থেকেই আমাদের প্রিয় রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে উন্নয়নে ধস নামে। স্থবির হয়ে যায় এই খাত সংশ্লিষ্ট অনেক শিল্প কারখানা। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। আগস্ট মাসের সংবাদ সম্মেলনে আমরা বলেছিলাম এই খাতের স্থবিরতা না কাটলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে এবং অনেক নাগরিক বেকার হবে। বর্তমানে রড, সিমেন্ট সহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় উৎপাদন অর্ধেক এর বেশি কমিয়ে দিয়েছে। ড্যাপে ফার হ্রাস করার পর ভবনের উচ্চতা কমে যাওয়াতে আমাদের হাতে নতুন প্রকল্প নেই বললেই চলে। ফলে আমাদের প্রকল্পগুলোতে নতুন নিয়োগ একেবারেই বন্ধ। উল্টো অনেকে বেকার হচ্ছেন কাজ না থাকায়। এই সব বেকার নাগরিক জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপকর্মে। ফলে আইন শৃংখলাতেই এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের স্বার্থেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।

মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এই ড্যাপের কারণে ঢাকা মহানগরের ৮০ শতাংশ অপরিকল্পিতই থেকে যাবে। শহর এমন একটা মরন ফাঁদে পরিনত হতে যাচ্ছে যাহাতে কোন রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়/দুর্ঘটনা ঘটলে অসংখ্য প্রাণহানী ঘটবে, কোনভাবেই উদ্ধারকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌছাতে পারবে না। অথচ এই বৈষম্যমূলক ড্যাপের জন্য এখনও পতিত সরকারের লবিষ্ট (কয়েকজন প্লানার্স) মায়া কান্না করে বেড়াচ্ছে নিজস্ব স্বার্থ হাছিলের জন্য। ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা শহরের পরিবেশের উন্নয়ন ও রাস্তা-ঘাট প্রসস্থকরণের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারণ ফার কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভূমি মালিকগণ ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে মহল্লার রাস্তাগুলো অপ্রস্থই থেকে যাচ্ছে এবং ফাঁকা জায়গা/সেমিপাকা জায়গা/পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনগুলো অস্বাস্থ্যকরই থেকে যাচ্ছে। এক কথায় ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ এরিয়াকে অপরিকল্পিত রেখে নগরবাসীকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে জমির তুলনায় জনসংখ্যার আধিকা বেশি এটা আমরা বার বার বলে আসছি। নতুন ড্যাপের কারণে ভবনের আয়তন এবং উচ্চতা কমেছে ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কৃষি জমি। রাজধানীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে ব্ল্যান্ড ফ্লো জোন, জলাশয় (ওয়াটার বঙি) দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা নিশ্চুপ হয়ে আছেন। সামনের বৃষ্টিতে ঢাকায় ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে ওয়াটার লড়ি ভরাট করার কারণে। বৈষম্যমূলক ড্যাপের মাধ্যমে তারা শুধু ভবনের আয়তন ও উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্য দিকে নজর নেই। এই ড্যাপে জলাশয় আইন এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, ২০ ফুট রাস্তা প্রসস্থ করণের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক এলাকায় আবাসিক ব্যবহার অর্থাৎ মিশ্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে শুদ্ধ আবাসিক এলাকা চাইলেও তৈরি করা সম্ভব না। নানা কারণে এই ড্যাপ বেআইনী। এই জন্য এই বেআইনী ড্যাপ অতি দ্রুত সংস্কার করার দাবী জানাচ্ছি। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করা অতি জরুরী।

উল্লেখ্য যে ২০০৮ এর ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কল্যাণে ঢাকা মহানগরের মহল্লার রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য হারে প্রসস্থ হচ্ছিল, ভবনগুলোতে একাধিক বেইজমেন্ট করার কারণে বহুসংখক গাড়ী পার্কিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছিল, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার ফলে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, সবুজ ও পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল। এছাড়াও টিনশেড/জরার্জীণ অস্বাস্থ্যকর পুরাতন ভবনগুলো ভেঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল। এই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর মত ভালো বিধিমালা বাতিল করা হলে তা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এতে ঢাকার জমির মালিকগণ ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫)" টি তার পূর্বসূরী "কাঠামোগত পরিকল্পনা" অর্থাৎ "ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান' গেজেট করার পূর্বেই চূড়ান্ত করা হয়েছে যা পরিকল্পনা প্রণয়নের মৌলিক মানদন্ডের সাথে সাংঘর্ষিক। টাউন ইম্পুভমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯৫৩ এর ৭৩ ধারার অধীনে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথমে সরকারের বিবেচনাধীন কাঠামোগত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর যথাযথ ধারাবাহিকতায় বিদ্যমান আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষজ্ঞ ও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, রাজউকের আওতাধীন এলাকার জন্য 'বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা' বা "ড্যাপ" চূড়ান্তকরণ করাই ছিল যৌক্তিকভাবে প্রত্যাশিত। ড্যাপে প্লাবনভূমিকে শ্রেণিবিভাগ করার সময় ২০০০ সালের ৩৬ নং আইনে প্রদত্ত প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তৎপরিবর্তে "মুখ্য জলস্রোত", "সাধারণ জলস্রোত" ও "সাধারণ প্লাবনভূমি" হিসেবে বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে শ্রণিবিভক্ত করার কোন সুযোগ ২০০০ সালের ৩৬ নং আইনে নেই। এ সকল অঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন ও স্থাপনা অনুমোদনের প্রস্তাবনা, আইন, আদালতের আদেশ ও জনস্বার্থ পরিপন্থী।

তিনি  বলেন, বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) প্রায় আড়াই বছর আগে প্রকাশ করা হয়। এটা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ক্ষোভে ফুসসে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোর জমির মালিকরা। তারা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছেন। আমরা রিহ্যাব এর পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে এই বৈষম্যমূলক ড্যাপ এবং নির্মাণ বিধিমালা নিয়ে অসংখ্যবার সভা করেছি, চিঠি দিয়েছি, নতুন প্রস্তাবনা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আমাদের বারবার আশ্বাস দিয়েছেন, বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে ড্যাপ এবং নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করবেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন পেরিয়ে গেলেও এই বিষয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আমরা অনেক দিন ধৈর্য ধরে ছিলাম। অন্য সংস্থা বা সংগঠনের মত আমরা রাস্তায় আন্দোলন না করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিব্রত না করে সহিষ্ণুতার সাথে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে। নানা ছলচাতুরি করে সময় ক্ষেপন করা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। আমরা আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে ড্যাপ ও নির্মাণ বিধিমালার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে বলতে চাই, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। কোন ধরনের কোন সময় ক্ষেপন এবং টালবাহানা চলবে না। এই সময়ের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে জমির মালিকসহ সব অংশীজনদের সাথে নিয়ে কঠোর আন্দোলন শুরু করা হবে। আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

শিহাব

×