অধিকাংশই পুঁজির সংকটে ভুগছে
গত দশ বছরে দেশে সংখ্যার বিচারে উদ্যোক্তা বাড়লেও তাদের অধিকাংশই পুঁজির সংকটে ভুগছেন বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শুমারিতে। উদ্যোক্তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ তাদের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন পুঁজির সংকট বা অপর্যাপ্ততার কথা। সম্প্রতি পরিসংখ্যান ব্যুরোর অডিটরিয়ামে ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতি দশ বছর পর পর এ ধরনের শুমারি করে সরকার।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি, অস্থায়ী ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টি এবং অর্থনৈতিক খানা ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি। গত তিনটি শুমারি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৩ সালে মোট ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৪৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট থাকলেও ২০১৩ সালে তা ১১০ শতাংশ বেড়ে ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি হয়।
পরের দশ বছরে তা ৫২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪ ইউনিট। তবে উদ্যোক্তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ তাদের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন পুঁজির সংকট বা অপর্যাপ্ততার কথা। তাদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বলেছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ নেওয়া তাদের পক্ষে সহজ হচ্ছে না।
অবকাঠামোর সমস্যার কথা বলেছেন ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ উদ্যোক্তা। ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ বলেছেন তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, যা ব্যবসা পরিচালনায় একটি সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ উদ্যোক্তার অভিযোগ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কথা বলেছেন ৮ শতাংশ উদ্যোক্তা।
উৎপাদন করলেও বিপণনে গিয়ে সমস্যায় পড়ার কথা জানিয়েছেন ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। আর ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ কাঁচামালের সংকটকে সমস্যা হিসাবে দেখিয়েছেন। ব্যবসা বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৭ জন উদ্যোক্তা। শুমারির ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।
পুঁজির এই সংকটকে ‘বড়’ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, “এটা খুব দুঃখজনক উপাত্ত। যত উদ্যেক্তা আছে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের প্রতিবন্ধকতা হিসাবে যেটা সবচেয়ে বেশি মনে করেন সেটা হচ্ছে ৮৬ শতাংশ মনে করেন তাদের মূলধন নেই। তাদের ৩৪ শতাংশ মনে করেন তাদের নিজের মূলধনও নাই, আবার ঋণ নিতে চাইলে সেটাও সহজ নয়।” মূলধন না থাকার পেছনে বিগত সময়ে একটি প্রভাবশালী মহলের অর্থলোপাটকে কারণ হিসাবে তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “বাংলাদেশে অনেক বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশে অর্থায়ন করতে গেলে উদ্যোক্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে উদ্যোক্তার অভাব নেই। কিন্তু তাদের কাছে মূলধন নেই। এটা আমার কাছে দুঃখ লাগে।” “আমরা এখন যে অর্থনীতি পেলাম, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে চলে গেছে। কতগুলো ব্যাংকের হিসাবও করা যায় না। কিছুই নাই, খালি প্রতিষ্ঠানটি আছি।”
শহরে প্রভাবশালীদের আর্থিক অনিয়মের কথা বলতে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কোম্পানি বেক্সিমকোর উদাহরণ টানেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, “বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরা রাতারাতি ধনী হওয়া শিল্পগোষ্ঠী; প্রকৃত অর্থে নামিদামি নয়। তাদের আর্থিক হিসাব থেকে দেখা গেল মূলধন বলতে কিছুই নাই। শুধু ঋণ আর ঋণ। বেক্সিমকোর কথা আমি বলছি।
“সরকার তিন চার মাস ধরে তাদের শ্রমিকদের অর্থায়ন করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর মতো কোনো পুঁজি নাই। বাংলাদেশের বৈষম্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে এই সূচক থেকে তা বোঝা যায়।” উপদেষ্ট বলেন, “শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি উদ্যোক্তা। অথচ তাদের প্রধান সমস্যা হলো সামান্য একটু পুঁজি বা অর্থায়ন। আর শহরের বড় বড় ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠান, অগণিত নতুন নতুন ব্যাংকের টাকা কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।”
শিক্ষাখাতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “গরিব শিক্ষক, এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের একটা ফান্ড আছে। তাদের নিজের কিছু টাকা এর সঙ্গে সরকারের দেওয়া কিছু টাকা যোগ করে তাদের সঞ্চয়। যেই প্রতিষ্ঠানের কাছে (সঞ্চয়) থাকে, সেই প্রতিষ্ঠান ছয় হাজার কোটি টাকা ইচ্ছা করে এমন ব্যাংকে রেখেছে, যে ব্যাংক সম্পূর্ণ দেউলিয়া। এটা ইচ্ছা করে করা হয়েছে। “এটা ছোট অংক নয়। এই টাকা পাওয়া গেলে এমপিওভুক্ত সবার অবসর ভাতা দিয়ে দেওয়া যেত। গরিব শিক্ষকদের পাওনা টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।”