ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা ॥ সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা ॥ সিপিডি

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, গত ছয় মাসে অর্থনীতিতে তেমন চাঞ্চল্য ফেরেনি। অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।
বুধবার রাজধানীর ধানম-িতে সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫, সংকটময় সময় প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন,  দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আসে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।
সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। বিগত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বেকারত্ব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছিল। সমাজে বৈষম্য বেড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি।
এ সময় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সংস্থাটি বলছে, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকার বেশিদিন থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় তারা।
অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা চাই সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না উল্লেখ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্পকালীন। এ সরকার জনগণের ম্যান্ডেটহীন ট্রানজেকশনাল সরকার। বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, যা এই সরকারের নেই।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। গত বছর একই সময় তা ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সফলতা এখনো দেখা যায়নি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জনসম্মুখে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি প্রকাশ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব চুক্তি উন্মুক্ত করা হয়নি।
সিপিডি বলছে, বিগত সরকারের সময়ের ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি চেয়ে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিল সিপিডি। তবে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে এই যুক্তি তুলে ধরে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য অন্তর্বর্তী সরকার দেয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়াচ্ছে যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
তিনি বলেন, জনগণ যে কর দেয়, সরকার পুরোপুরি পায় না। সরকারের সুযোগ ছিল এসব জায়গায় হাত দেওয়ার, কিন্তু দেয়নি। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেনি ভ্যাট বাড়াতে। তারা বলেছে, যেকোনো উপায়ে রাজস্ব বাড়াতে। কিন্তু সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ কর বাড়াচ্ছে।
সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে বৈপরীত্য নেই, উভয়ই সমান্তরালে চলবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এর আগে রাজনৈতিক একটা সমঝোতায় আসতে হবে, যাতে সংস্কার অব্যাহত থাকে।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় রাজনৈতিক সংস্কার আর অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে বৈপরীত্য নেই। একটিকে আরেকটির সঙ্গে সমান্তরালেই চলতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কারও করতে হবে, অর্থনৈতিক সংস্কারও করতে হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সংস্কার ছাড়া কেবল ইলেক্টরাল সংস্কার দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার হবে না। দলগুলোর ভেতরে যে সংস্কার সেখানে গণতন্ত্রায়ন একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে হতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা অনেক প্রস্তাব দিয়েছি। তবে তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে গেলে একটু সময় লাগবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যতদ্রুত সম্ভব আমাদের গণতান্ত্রিক একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। এই পথে আমরা যদি একটি সমঝোতায় আসতে পারি যে এখন যেসব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কার করা হচ্ছে পরবর্তী সময়ে তা অব্যাহত রাখব। সেটা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য এবং ৫ আগস্টের শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
 মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগের জন্য আস্থার পরিবেশ ফিরে আসেনি। আগেও অনিশ্চয়তা ছিল, এখনো চলমান।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মধে কোনো বৈপরীত্য নেই। দুটোই করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার পার্টিগুলোর ভেতর থেকে করতে হবে। নির্বাচনী সংস্কার দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার হবে না।

দলের ভেতরে সংস্কারের গণতান্ত্রিক  প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে। অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হলেও একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে এখন দ্রুত যে কাজটি করতে হবে, একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ যদি সমঝোতার মধ্য দিয়ে আসতে পারে তাহলে যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো চলমান রাখবে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগ এসেছিল কর ফাঁকি রোধ, ঢালাও কর অব্যাহতি কমিয়ে আনা ও পরোক্ষ করের মধ্য থেকে বের হয়ে আসা। এটা করতে পারলে দেশে আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের যে কথা বলি, সেটা কমত। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সেই কাজটি করার সময় ছিল। কিন্তু এ সরকার সেটা করতে পারছে না।
এলএনজি আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা নন-বাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক। যেটা আগামী সরকার ইচ্ছা করলে চুক্তি করতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে।
তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব বলে জানান সিপিডির গবেষণা ফেলো হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী। তিনি বলেন, তেলের মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মেথোডলজি ভুল। কারণ সেখানে বেশ কিছু কম্পোন্যান্ট আছে, যেখানে মার্জিন ধরা হচ্ছে ইউটিলিটির ওপর। বিশ্বের কোনো দেশে ইউটিলিটির ওপর মার্জিন ধরা হয় না। সেখানে ৫ শতাংশ মার্জিন ধরা হচ্ছে। এটা একটি কারণ।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বিপিসির যে মেথডোলজি সেখানে সাতটি স্তরে ভ্যাট-ট্যাক্স রাখা আছে। আর বিআরসির তিনটা স্তরে ভ্যাট-ট্যাক্স ধরা হয়েছে। এটাও ঠিক না। আর তৃতীয়টি হলো, ডলারের যে বিনিময় হার, বিপিসির ক্ষেত্রে পরিষ্কার না। বিপিসি কোন ব্যাংকের ডলারের বিনিময় হার ব্যবহার করছে, কীভাবে অ্যাডজাস্ট করছে, এটা পরিষ্কার করে বলেনি। বিপিসির মেথোডলজির ভুলের কারণে দাম কমছে না। যদি বিপিসির মেথোডলজিতে যায় তাহলেও ১০ টাকা দাম কমবে, আমাদের মেথোডলজিতে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব।

×