গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভর করে এগিয়েছে দেশ
২০১৩ সালের পর ২০২৪ সালে শুরু হয় ৪র্থ অর্থনৈতিক শুমারি। এই এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েছে আশাব্যঞ্জকভাবে। অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ ৪৯ হাজার থেকে বেড়ে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ছাড়িয়েছে। তবে এই কর্মকা-ে উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ কমেছে।
গত এক দশকে এই কমার হার ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। তবে ব্যাপকভাবে বেড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির অংশগ্রহণ। মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে ৭০ দশমিক ২৭ শতাংশ ইউনিট গ্রামে এবং ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ শহরে অবস্থিত। বলা চলে, গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভর করেই গত এক দশকে এগিয়েছে দেশ।
বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি-২০২৪ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি ড. কে এ এস মুর্শিদ এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। অনুষ্ঠানে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে উপপ্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান শুমারির বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪০ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯৯টি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টিতে। দেশে বর্তমানে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি স্থায়ী, ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার ২১টি অস্থায়ী এবং ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি পারিবারিক অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ২৭ শতাংশ ইউনিট গ্রামে এবং ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ শহরে অবস্থিত।
স্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৩৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮টি, শহরাঞ্চলে রয়েছে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৪৬টি; যা ১০ বছর আগে ছিল গ্রামাঞ্চলে ২৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৫৯টি আর শহরাঞ্চলে ছিল ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৬৩২টি। অস্থায়ী পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টির মধ্যে শহরাঞ্চলে রয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৯টি আর গ্রামে দুই লাখ ৯১ লাখ ৭১২টি; যা ২০১৩ সালে ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৩টি।
এ ছাড়া দেশের মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিল্প খাতের, আর ৯১ দশমিক ২৩ শতাংশ সেবা খাতে। শিল্প খাতের ইউনিট ২০১৩ সালে ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে কমে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অঞ্চলভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক ০৩ শতাংশ অর্থনৈতিক ইউনিট ঢাকা বিভাগে অবস্থিত।
বেড়েছে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ॥ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্যে সেবা খাতের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। ২০১৩ সালে যেখানে সেবা খাতের ইউনিট ছিল ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২টি, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি আট লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬টিতে। এর ফলে মোট প্রতিষ্ঠানে সেবা খাতের অবদান ৮৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ২৩ শতাংশে।
অপরদিকে উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম। ২০১৩ সালে শিল্প খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ছিল নয় লাখ দুই হাজার ৫৮৩টি, যা ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ ৪১ হাজার ৪৬৮টি। এ হার এক দশকে মাত্র ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ২০০১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিটে এই খাতের অবদান ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে বলা হয়, ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১২.১৪ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ১১.৫৪ শতাংশে নেমে আসে। এ হিসাবে টানা দুই শুমারিতেই কমেছে উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানের অবদান।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কমেছে নারীর অংশগ্রহণ ॥ প্রতিবেদন অনুসারে, অর্থনৈতিক ইউনিট পরিচালনায় পুরুষের আধিপত্য এখনো ব্যাপক। ২০২৪ সালের শুমারি অনুসারে, ৯৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ ইউনিট পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্যদিকে নারীদের পরিচালিত ইউনিটের সংখ্যা সাত লাখ ৬৮ হাজার ৪২টি, যা মোট ইউনিটের মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৩ সালের শুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিটে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে।
শুধু নেতৃত্ব নয়, কর্মসংস্থানেও নারীদের অংশগ্রহণ ২০১৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কমেছে। দেশে বর্তমানে ৩ দশমিক ০৭ কোটি শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের ৫৬ দশমিক ৮২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে নিযুক্ত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বর্তমানে ৩২০টি অর্থনৈতিক ইউনিট হিজড়া জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এই প্রতিবেদন নীতিনির্ধারক, গবেষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, একাডেমিসিয়ান, তাদের প্রয়োজন মাফিক ভবিষ্যৎ নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুমারির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন এবং সেবা খাতের হালনাগাদ তথ্য জানা যাবে।’
বিশেষ অতিথি ড. কে এ এস মুর্শিদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক শুমারি আমাদের জন্য একটি মূল্যবান তথ্যভান্ডার। এটি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের চিত্রই তুলে ধরে না, বরং শহর ও গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মরত জনবলের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কাঠামো, উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-সম্পন্ন খানার তথ্য জানা যাবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির গতিধারা নির্ধারণে সহায়ক হবে।’
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তি শক্তিশালী করবে। এই শুমারির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য কেবলমাত্র নীতিনির্ধারকদের জন্য সহায়ক হবে না। বরং গবেষক, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবে।’
উল্লেখ্য, এটি দেশের ৪র্থ অর্থনৈতিক শুমারি। প্রথম শুমারি হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। প্রতি ১০ বছর পর পর এ শুমারি করা হয়। এবারের শুমারির প্রাক্কলিত বাজেট ছিল ৫৭৯.৫২ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক শুমারির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের অর্থনীতিতে সময়ের বিবর্তনে যে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে তা পর্যবেক্ষণ করা এবং অকৃষিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকা-ের হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরা। এই শুমারির মাধ্যমে অকৃষিমূলক অর্থনৈতিক কর্মকা-ের শ্রেণিবিন্যাস নির্ধারণ, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা নিরূপণ, কর্মসংস্থান পরিস্থিতির মূল্যায়ন, বিনিয়োগ ও মূলধন কাঠামোর বিশ্লেষণ, বিভিন্ন খাতের প্রবৃদ্ধির ধারা পর্যবেক্ষণ, শিল্পোন্নয়নের জন্য নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের জন্য তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।