ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

১০ ফেব্রুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

১০ ফেব্রুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

১০ ফেব্রুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) নতুন মুদ্রানীতি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আর বাড়ানো হবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অপরিবর্তিত রাখা হবে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বরাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এবার সুদহার বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। এখন তো মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে সুদহার বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই। জানুয়ারি মাসের রিপোর্ট দেখেই মূলত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। যে কারণে এবারের মুদ্রানীতির সময় পরিবর্তন করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগেরদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এটি অনুমোদন করা হবে। ইতোমধ্যে মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ অনেকটাই চূড়ান্ত করে ফেলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশে প্রায় তিন বছর হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এদিকে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার চিন্তা। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ালে পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ।
দেশের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। ফলে প্রথমবারের মতো তিনি মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, এবারও সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে মুদ্রানীতি কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন নেওয়া বাকি। আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পর্ষদ সভায় এটি অনুমোদন হলে, পরদিনই তা ঘোষণার করা হবে। এর আগে গত ১৮ জুন চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জনকণ্ঠকে বলেন, মনিটারি পলিসি নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই। এই মুহূর্তে বাজারে সব কিছুর দাম সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬। এই হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। শুধু তা-ই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণপত্রের নিষ্পত্তি হয়েছে কম।
ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনী ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এ সবকিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধি, কেবল কোভিড-১৯-এর ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে ইতিবাচক ফল আসেনি বাজারে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত বছরের ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি আগের মাসের ১১.৩৮ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে ১০.৮৯ শতাংশে নেমেছে। 
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও তলানিতে নেমে এসেছে, অর্থনীতিতে যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখন এক ধরনের স্ট্যাগফ্লেশন (নি¤œ প্রবৃদ্ধি+ উচ্চ মূল্যস্ফীতি+ উচ্চ বেকারত্ব) চলছে অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতিতে কী পদক্ষেপ নেবে সেটাই দেখার বিষয়। 
তবে অনেকেই মনে করেন, উন্নত বিশ্বে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সম্ভব নয়। যেসব দেশের ৯০ শতাংশই ভোক্তাঋণ, সেখানে তা সম্ভব হতে পারে। তারা বাড়ি, গাড়িসহ নানা কাজে ঋণ নেন। ফলে সেসব দেশে সুদহার বাড়িয়ে ভোগব্যয় কমানো যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ ঋণই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেওয়া হয়।

এখানে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, সরকারি তথ্যেই যার প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্টো বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে ঠেকেছে, অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে সর্বনি¤œ অবস্থায় নেমেছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসা করা প্রায় অসম্ভব। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নীতিসুদ বৃদ্ধি করে এখন পর্যন্ত লাভ হয়নি।

নীতিসুদ বৃদ্ধির কী প্রভাব পড়বে, তা খতিয়ে দেখা হয়নি। ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সময়ও খতিয়ে দেখা হয়, সেই ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা কতটুকু। কিন্তু নীতিসুদ বৃদ্ধির মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তা করা হয় না। এ ছাড়া ভ্যাট বৃদ্ধি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সমালোচনা করেন তিনি।
এদিকে গভর্নর আহসান মনসুর ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শীঘ্রই বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের মার্জিন ছাড়াই ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে নেওয়া মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন সফল হচ্ছে না। এ এজন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন।

×